দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়নে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে সরকার এখন প্রকল্পের দুটি প্রধান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি জানিয়ে বাংলাদেশে অবস্থিত জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বরাবর দুটি চিঠি পাঠিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এতে প্রকল্প পরিচালক মো. আফতাব হোসাইন স্বাক্ষর করেন।
ডিএমটিসিএলের পরিচালনা পরিষদের ৭১তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবে (ডিপিপি) বরাদ্দের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয় চাওয়া ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সুপারিশ করা হয়। সেই অনুযায়ী জাইকার কাছে অনুমতি চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা হয়। তবে ‘অতিরিক্ত ব্যয়’ বলতে ঠিক কত শতাংশ বাড়তি খরচ বোঝানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
বাতিলের প্রস্তাব দেওয়া দুটি প্যাকেজ হলো—সিপি-২ এবং সিপি-৫। প্রথমটি চীনের সিনোহাইড্রো, যারা ডিপোর অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণের কাজ পেয়েছিল। দ্বিতীয়টি জাপানের কাজিমা করপোরেশন, যাদের দায়িত্ব ছিল নর্দা থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত টানেল ও স্টেশন নির্মাণের কাজ।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুখ আহামেদ বলেন, “আমরা আসলে চুক্তি বাতিল করতে চাই না, বরং আলোচনার পথ খুলতে চাই। যদি তারা ব্যয় কমাতে রাজি হয়, তাহলে কাজ চলবে। না হলে নতুন দরপত্র আহ্বান করা হবে।” তার মতে, ২০১৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী একই খরচে ২০২৪ সালে প্রকল্প চালানো সম্ভব নয়। বাজারদর, মূল্যস্ফীতি ও ডলারের মান বিবেচনায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি ব্যয়কে স্বাভাবিক ধরা যেতে পারে, তবে ৫০ শতাংশের বেশি হলে তা অগ্রহণযোগ্য।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া এই পাতাল মেট্রোরেল প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেলেও নির্মাণে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ঠিকাদার নিয়োগ সম্পন্ন হলেও নতুন দরপত্র, অনুমোদন এবং চুক্তি জটিলতায় প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়েছে।
প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে জাইকা দিচ্ছে প্রায় ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, আর বাকি অংশ বহন করবে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এখন ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চিন্তায় সরকার বিকল্প অর্থায়নের পথ খুঁজছে এবং প্রয়োজনে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত দিয়েছে।
বুয়েটের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “চুক্তি বাতিলের মতো পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে। আলোচনা করে ব্যয় নির্ধারণ করা উচিত ছিল। কারণ ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দরের পরিবর্তন স্বাভাবিক বিষয়।”
তিনি আরও বলেন, “এই সিদ্ধান্তের কূটনৈতিক প্রভাবও বিবেচনা করা জরুরি। জাপান বাংলাদেশের একটি প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। তাই ব্যয় কমানো এবং সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এমআরটি লাইন-১-এর মোট দৈর্ঘ্য ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার, যার মধ্যে ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার যাবে মাটির নিচ দিয়ে এবং বাকি ১১ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার উড়ালপথে। রূপগঞ্জের ৯৩ একর জমিতে ডিপো নির্মাণের কাজ আংশিক সম্পন্ন হলেও মূল টানেল এবং স্টেশন নির্মাণ কার্যত বন্ধ হয়ে আছে।
ডিএমটিসিএলের সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, “বর্তমানে এমআরটি লাইন-১ ও ৫ প্রকল্পের কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে।”
এই অবস্থায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সরকার একদিকে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে চাচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়েছে। এখন দেখার বিষয়, জাইকা সরকারের প্রস্তাবে কী জবাব দেয় এবং আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পটি নতুন গতি পায় কি না।



















