ক্ষমতার জোরে সম্পদের পাহাড়, কারাগারে সাবেক সেই অতিরিক্ত ডিআইজি..

Md Borhan Uddin avatar   
Md Borhan Uddin
বগুড়ায় ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) হামিদুল আলম মিলন জামিন না পেয়ে কারাগারে গেছেন। একইসঙ্গে তা..

সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে বগুড়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এ আত্মসমর্পণ করে তিনি জামিন চান। বিচারক মেহেদী হাসান তার আবেদন না মঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

যে অভিযোগে মামলা

মামলাটি করেন জাহেদুর রহমান তোফা। অভিযোগের মূল বিষয় ডেভেলপমেন্ট চুক্তির আড়ালে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নালিশি সম্পত্তির মালিকের পূর্বের আমমোক্তারনামা বাতিল করে হামিদুল আলম মিলনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মেধা এন্টারপ্রাইজের নামে নতুন আমমোক্তারনামা (দলিল নং ৩২৯৭) ইস্যু করানো হয়। এতে পুরো প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে মিলনের হাতে।

চুক্তি অনুযায়ী, ‘মেধা শাহ ক্যাসেল’ নামে বহুতল ভবন নির্মাণের দায়িত্ব নেন তিনি এবং নির্মাণকালীন মূল্যে বাদীপক্ষকে একটি ফ্ল্যাট হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে প্রতি বর্গফুট ১,৫০০ টাকা হিসাব ধরে তিনি বাদীপক্ষের শ্যালকের কাছ থেকে আগাম এক লাখ টাকা গ্রহণ করেন।

বাদীপক্ষের অভিযোগ, টাকা নেওয়ার পর মিলন চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি করেন, সময়ক্ষেপণ করেন এবং ফ্ল্যাট হস্তান্তর নিয়ে কোনো অগ্রগতি দেখাননি। প্রকল্পের কাজ বা চুক্তির শর্তাবলি বিষয়ে বারবার জিজ্ঞেস করা হলেও তিনি স্পষ্ট জবাব দেননি।

এজাহারে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, চুক্তির সাক্ষী হিসেবে স্ত্রী শাহাজাদী আলম লিপির স্বাক্ষর চাইলে তিনি তা এড়িয়ে যান। বাদীপক্ষের দাবি, এই আচরণ পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ আরও বাড়ায়। তাদের ভাষায় চুক্তি, দলিল ও অর্থ নেওয়া সবই ছিল প্রতারণার ধারাবাহিক কৌশল।

সোমবার ওই মামলায় আদালতে হাজির হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং একই মামলার আসামির স্ত্রী শাহজাদী আলম লিপিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়।

বাধ্যতামূলক অবসর

সারিয়াকান্দির হামিদুল আলম মিলন ছিলেন পুলিশে এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তিনি মেট্রোপলিটন পুলিশ, রেঞ্জ ও সদর দপ্তরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তার কর্মজীবন বিতর্কের মধ্যেই প্রবাহিত হয়েছে। নিয়মিত অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রভাব খাটানো এবং দায়িত্বের বাইরে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মিলন অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে ছিলেন। সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী ছুটিতে থাকা কর্মকর্তা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু অভ্যন্তরীণ তদন্তে দেখা যায়, তিনি ছুটির আড়ালে বগুড়া-১ আসনে তার স্ত্রী শাহাজাদী আলম লিপির নির্বাচনি প্রচারণায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে ভোটের কাজে ব্যবহার, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করা এবং নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।

পুলিশের ভেতরের সূত্র জানায়, মিলনের এমন আচরণকে গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে দেখা হয়েছিল। বহুবার শাস্তির দাবি ওঠার পরও শেষ পর্যন্ত তিনি বরখাস্ত হননি। বিভিন্ন প্রভাবশালী সংযোগের মাধ্যমে শাস্তি হালকা করানো হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল।

শেষ পর্যন্ত ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মিলনকে শাস্তি হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। প্রশাসনিক ভাষায় বলা হয়েছিল- ‘সেবা স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত’।

তবে পুলিশ সূত্রের মতে, একজন কর্মকর্তার ছুটির আড়ালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া এবং সরকারি সুবিধা ব্যবহার করা, তার অবস্থান দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এখন প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ মামলায় তার নাম আসায়, পুরোনো বিতর্ক নতুন করে মানুষের সামনে এসেছে।

অস্বাভাবিক সম্পদের পাহাড়

বগুড়ায় সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি হামিদুল আলম মিলন ও তার স্ত্রী শাহাজাদী আলম লিপিকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে জনমনে প্রশ্ন ও অবিশ্বাস জমে আসছিল। মূল অভিযোগ অস্বাভাবিক হারে সম্পদ বৃদ্ধি।

সদ্য সমাপ্ত অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শহরের কয়েকটি নামি আবাসিক প্রকল্প দিয়ে শুরু করা সম্পদ সঞ্চয় ক্রমান্বয়ে বেড়ে শতাধিক ফ্ল্যাটে পৌঁছেছে মিলনের। শহরের ভেতর, উপকণ্ঠ ও উপজেলা পর্যায়ে একরে একরে জমি ক্রয় করা হয়েছে। ফ্ল্যাট, প্লট, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্লক সব মিলিয়ে সম্পদ বিস্তৃত।

নদীর চর, পুকুর, মৎস্যঘের এবং খেলার মাঠেও তাদের দখলের অভিযোগ রয়েছে। দলিলপত্রের ভিত্তিতে দেখা গেছে, এসব সম্পত্তির মালিকানা কখনও মিলন-লিপির নামে, কখনও ভাইবোন বা শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের নামে নিবন্ধিত। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, শহরের আঞ্চলিক বাস টার্মিনালের একটি বড় অংশও দম্পতির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, জেলা ও উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে দলিল সংগ্রহ করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য কে কোথায়, কীভাবে, কত টাকায় সম্পদ কিনেছেন তা যাচাই করা।

ভুক্তভোগীরা জানান, ‘ফ্ল্যাটের জন্য আগাম টাকা নিয়ে ওই দম্পতি যোগাযোগ এড়িয়ে যান। অফিসে গেলে বারবার বিভিন্ন অজুহাত দেখানো হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি জানাতে অনীহা দেখানো হয়।’

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য

মিলন-লিপি দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা অনেকেই নাম প্রকাশ করতে চাননি। কারণ তাদের কথা অনুযায়ী, ‘ওদের বিরুদ্ধে কথা বললে বিপদ হতে পারে’— এই ভয় বহু বছর ধরে এলাকায় চেপে বসে ছিল। তবু কয়েকজন কথা বলেছেন।

সজল নামের ব্যবসায়ী কয়েক বছর আগে মিলনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্লট কেনাবেচার চুক্তি করেছিলেন। তিনি বলেন, আমাকে দামে সুবিধা দেওয়ার কথা বলে আগাম টাকা নিয়েছিল। পরে দেখি, সেই জমির মালিকানা নিয়ে তিনজনের সঙ্গে বিরোধ। বিষয়টা জানতে চাইলে হুমকি-ধমকি শুনতে হয়েছে। তখনই বুঝেছি এদের সঙ্গে লেনদেন মানে গর্তের দড়ি ধরা।

মনিরা বেগম নামের ভুক্তভোগীর অভিযোগ, ফ্ল্যাটের চুক্তি করে টাকা নিলেও পরে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অফিসে গেলে বলা হয় স্যার ব্যস্ত, পরে আসুন। এভাবে ঘুরিয়েই রেখেছে। মামলা করার পরই ওদের চরিত্রটা পরিষ্কার বুঝেছি।

দুদকের এক কর্মকর্তা গোপনীয়তার শর্তে বলেন, মিলনের যেসব সম্পদ বগুড়ায় পাওয়া গেছে, তার একটা বড় অংশ তিনি চাকরির বেতন দিয়ে করতে পারতেন না এটা স্পষ্ট। তাই সম্পদ অনুসন্ধানে আমরা নথি সংগ্রহ করছি। কিছু দলিল সন্দেহজনক মনে হয়েছে। মালিকানা বদলের ধরনও প্রশ্নবিদ্ধ।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। চাকরি জীবনে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু তিনি প্রভাব খাটিয়ে বাঁচতেন। এবার আদালত যেদিকে এগোচ্ছে, সেটা আগের অভিযোগগুলোর বাস্তব পরিণতি বলা যায়।

কারাগারে থাকায় অভিযোগের ব্যাপারে মিলনের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তার স্ত্রী শাহাজাদী আলম লিপির ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

没有找到评论


News Card Generator