উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ছোট্ট আফিয়া ফেরদৌসকে। হাসপাতালের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তার খালা, একটিবার দেখার আশায় হাতজোড় করে খুঁজে ফিরছেন সবাইকে।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের করিডোরজুড়ে ভারী নীরবতা। ভেতরে আহতদের গোঙানির শব্দ, বাইরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত এক তরুণী। তাঁর হাতে একটি ছোট্ট মেয়ের ছবি। কাউকে দেখলেই ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছেন— “ওকে দেখেছেন? কোথাও দেখেছেন আমার কলিজার টুকরাটাকে?”
তরুণীটির নাম হাবিবা সুলতানা। তিনি নিখোঁজ আফিয়া ফেরদৌসের খালা। আফিয়া মাইলস্টোন কলেজের বাংলা ভার্সনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। বৃহস্পতিবার সকালে দিয়াবাড়ি এলাকায় ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় কলেজ ভবনের একাংশ ধসে পড়ে। তখন থেকেই খোঁজ মিলছে না ছোট্ট আফিয়ার।
হাবিবার কণ্ঠে কান্না চেপে রাখা যায় না। সাংবাদিকের চোখে চোখ রেখে বললেন—
“আমার ভাগনিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সকাল থেকেই হাসপাতালে ছুটছি। প্রথমে গিয়েছিলাম উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে, সেখানেও কিছু পাইনি। এরপর এখানে এসেছি। জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়েছি, কিন্তু কারো কাছে ওর নাম নেই। কারো কাছে ওর মুখ মনে নেই। আমি এখন ওর বাবা-মাকে কী জবাব দেব?”
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন স্বজন কাঁধে হাত রেখে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তেই হাবিবার চোখে শুধুই ছোট্ট আফিয়ার মুখ। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন—
“আফিয়ার বাবা-মা এখনো ধ্বংসস্তূপে খুঁজছে। আমি হাসপাতালে খুঁজছি। কেউ কি একটু বলে দেবে— আমার কলিজার টুকরাটা কোথায়?”
এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য উত্তরার ভয়াবহ সেই দিনের কষ্টগুলোকে আরও গভীর করে তুলছে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উত্তরার দিয়াবাড়িতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। ছিটকে পড়ে ভবনের উপর। মুহূর্তেই ভবনটি কেঁপে উঠে ধসে পড়ে নিচে।
এখন পর্যন্ত এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক, যাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষার্থী।
হাসপাতালে গিয়েও বহু স্বজন এখনো খুঁজে পাননি তাদের প্রিয়জনদের। হাবিবার মতো অনেকেই হাতে ছবি নিয়ে ঘুরছেন এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে, কখনো ডাক্তার, কখনো নার্সের কাছে, কখনো অপরিচিত কারও কাছে একটাই প্রশ্ন— “ওকে দেখেছেন?”
এই দুর্ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, আমাদের প্রস্তুতির কতটা ঘাটতি রয়েছে। শুধু উদ্ধার কাজেই নয়, আহত ও নিখোঁজদের তথ্য আদান-প্রদান, স্বজনদের সহযোগিতায় কতটা এলোমেলো অবস্থা— তা স্পষ্ট হয়ে গেছে এই কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই।
আর এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই ছোট্ট আফিয়ার খবর কেউ জানে না। হয়তো কোনো ওয়ার্ডে নিঃসাড় পড়ে আছে, হয়তো অন্য কোথাও চিৎকার করে ডাকছে মায়ের জন্য। কিন্তু এখনো নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছে না।
আফিয়ার খালা হাবিবার কান্নায় অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। হয়তো কিছুক্ষণ পর তিনি আবার যাবেন জরুরি বিভাগে, আবার জিজ্ঞেস করবেন কাউকে—
“দয়া করে বলুন, কোথাও দেখেছেন আমার কলিজার টুকরাকে?”