জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ায় সংবিধানের ওপরে সনদকে স্থান দেওয়া ও আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না—এমন শর্তে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মতে, কোনো নথি সংবিধানের ঊর্ধ্বে হতে পারে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারো উত্তাপ ছড়িয়েছে জুলাই জাতীয় সনদকে ঘিরে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে পাঠানো পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দলটির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, খসড়ার অনেক প্রস্তাবে তাদের মৌলিক আপত্তি নেই। তবে মূল আপত্তি হলো—সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া এবং সেটিকে নিয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না রাখার বিষয়টি। বিএনপি মনে করে, কোনো অবস্থাতেই কোনো নথি বা ডকুমেন্টকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া সম্ভব নয়, আর বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করার সুযোগও গ্রহণযোগ্য নয়।
গত সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে নেতারা মত দেন, খসড়ার পূর্ণাঙ্গ রূপটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে এবং দলীয় অবস্থান স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। এজন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদসহ তিনজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে দলের চূড়ান্ত অবস্থান উপস্থাপন করার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, জুলাই সনদের ৮৪ দফা প্রস্তাবের মধ্যে অনেকগুলোতে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। তবে যেসব প্রস্তাবে আপত্তি বা ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়েই এখন মূলত আলোচনা চলছে। বিএনপির অবস্থান হলো, যেসব প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছাড়াই কার্যকর করা সম্ভব, সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। তবে যেসব প্রস্তাব সরাসরি সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে যুক্ত, সেগুলো আগামী জাতীয় সংসদ গঠন হওয়ার পরেই বাস্তবায়ন করা উচিত।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আরও একটি বিষয় আলোচিত হয়—সনদের প্রথম খসড়ায় উল্লেখ ছিল যে, সংবিধান সংশোধন এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নতুন সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় সেই অঙ্গীকার আর রাখা হয়নি। বিএনপি মনে করে, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি বাদ দেওয়া রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যেও কিছু মৌলিক বিষয় আছে, যেগুলোতে ছাড় দিতে রাজি নয় দলটি। এর মধ্যে অন্যতম হলো—প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। এছাড়া নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচন করার প্রস্তাবও রয়েছে, যা বিএনপি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। দলটি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার পক্ষে থাকলেও এমন কোনো প্রস্তাব সমর্থন করে না, যেখানে প্রধানমন্ত্রী কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বেন।
জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে বিএনপির অবস্থান এখনও চূড়ান্ত হয়নি। খসড়াটি নিয়ে দলীয় আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপি প্রথমে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করে। এই মঞ্চ বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিত্র। সেখানে আলোচনা হয়, কোন কোন প্রস্তাবে ছাড় দেওয়া সম্ভব এবং কোন কোন বিষয়ে অটল থাকা হবে। জানা গেছে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া কয়েকটি মৌলিক প্রস্তাবে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হওয়ার আভাস দিয়েছে।
আজ বুধবার বিকেল ৪টার মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া নিয়ে দলীয় মতামত জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হচ্ছে। বিএনপির অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও মিত্র দলের সঙ্গে বৈঠকের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে—দলটি চূড়ান্তভাবে কী অবস্থান নেয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই সনদকে ঘিরে বিএনপির এই অবস্থান শুধু দলীয় কৌশলের অংশ নয়, বরং ভবিষ্যৎ সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার দিকনির্দেশনাও তৈরি করছে। দলটি যদি সংবিধানের ঊর্ধ্বে কোনো নথিকে মানতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে এটি রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হয়ে দাঁড়াবে।