প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্নে শহীদ হয়েছিলেন জুলাই বীররা। তাদের আত্মত্যাগেই সূচিত হয় নতুন বাংলাদেশের পথচলা।
জুলাই ১৬—বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি অনন্য দিন। ২০২৪ সালের এই তারিখে ঘটে যাওয়া ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতনের ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল এক মহাকাব্যিক বীরত্বগাথা, এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনার ঘোষণা।
এই বিশেষ দিনে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জুলাই শহীদরা চব্বিশের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে এক মহাকাব্যিক বীরত্বগাথা রচনা করে গেছেন। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্রের। তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই সম্ভাবনাকে সফল বাস্তবতায় রূপ দিতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
তিনি শহীদদের স্মরণ করে বলেন, আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই সকল শহীদদের, যারা জাতিকে স্বৈরাচারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও পরিবারের কল্যাণে বহুমুখী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে।
এরই অংশ হিসেবে গঠিত হয়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ ও ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। শহীদ পরিবারদের দেওয়া হচ্ছে এককালীন ৩০ লাখ টাকা ও মাসিক ভাতা। আহত আন্দোলনকারীদের পুনর্বাসনে নেওয়া হচ্ছে আলাদা কর্মসূচি।
ড. ইউনূস আরও বলেন, শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে গেজেট প্রকাশসহ নানা সরকারি পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমরা চাই, তাদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় শুধু নয়, প্রতিটি প্রজন্মের হৃদয়ে জাগ্রত থাকুক।
প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে ‘জুলাই শহীদ দিবস’। বিগত বছরের ১৬ জুলাই ছাত্রদের আন্দোলনে গুলি চালিয়ে, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার যে দানবীয় রূপ দেখিয়েছিল, সেই দিনটি ইতিহাসে রক্তাক্ষরে লেখা থাকে।
চট্টগ্রাম, রংপুর ও ঢাকায় একযোগে গুলিবিদ্ধ হন অন্তত ছয়জন। এরপর বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। শহীদদের রক্তে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ, আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের দাবিতে। জনগণের অনমনীয় প্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পরাজিত হয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের প্রতিটি সেক্টরে শুরু হয় সংস্কারপ্রক্রিয়া। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু হয়, যাতে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে নিশ্চিত করা যায়।
আজকের বাংলাদেশ, যেখানে জনগণের কণ্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে স্বৈরাচারের বদলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটছে রাষ্ট্র—সেই বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে হাজারো অদেখা-অজানা জুলাই শহীদের রক্তের স্রোতধারায়।
ড. ইউনূস বলেন, জুলাই শহীদদের আত্মত্যাগ শুধু একটি আন্দোলনের অংশ নয়, এটি একটি চেতনার নাম, একটি জাতীয় রূপান্তরের ভিত্তিপ্রস্তর। এই চেতনাকে ধারণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি সমাপ্তিতে বলেন, আসুন, আমরা সবাই মিলে এই দিনটিকে শুধু স্মরণ নয়, শ্রদ্ধা, শিক্ষা ও প্রতিজ্ঞার দিন হিসেবে পালন করি। শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করছি।