ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতার আবহে হঠাৎ করেই যুদ্ধ-সংকেত যেন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে শুধু কথার লড়াই নয়, সরাসরি সামরিক সংঘাতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে ছুটে আসছে মার্কিন যুদ্ধবিমান, মোতায়েন করা হচ্ছে রণতরী, পাঠানো হয়েছে হাজার হাজার সেনা—সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেন প্রস্তুত হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধমঞ্চ।
বিশ্বের অন্যতম আধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-২২ র্যাপ্টর এবং স্টেলথ প্রযুক্তিতে নির্মিত এফ-৩৫ লাইটনিং ফাইটার জেট ইউরোপের ঘাঁটি থেকে একে একে উড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে। এই জেটগুলোর সঙ্গে রয়েছে রিফুয়েলিং ট্যাংকার, যার মাধ্যমে যুদ্ধবিমানগুলো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অব্যাহতভাবে আকাশ আক্রমণ চালাতে পারে। এক অর্থে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আকাশক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্য অনুসারে, শুধু গত কয়েক দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে অন্তত ৩০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর এই গতিবিধি দেখে বোঝাই যাচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা রাখছে না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, শুধু ইউরোপ থেকেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আগে থেকেই থাকা ঘাঁতিগুলোতেও নতুন করে বিমান এবং সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করা হয়েছে। অর্থাৎ, একদিকে আকাশপথে শক্তিশালী উপস্থিতি, অন্যদিকে সমুদ্রপথে রণতরীর অবস্থান—দুই দিক থেকেই চাপে রাখা হচ্ছে ইরানকে।
এই মুহূর্তে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস কার্ল ভিনসন উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আরও একটি বিমানবাহী রণতরী একই গন্তব্যে রওনা হয়েছে, যেটি পৌঁছালে সমুদ্রপথে মার্কিন শক্তির উপস্থিতি দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের মাটি ব্যবহার করে হামলা চালাতে চাইলে সে দেশের অনুমতি নেয়। তবে এবারে কিছুটা ব্যতিক্রম। বিবিসি জানায়, যুক্তরাজ্যের সাইপ্রাসে অবস্থিত আকাশঘাঁটি বা পর্তুগালের টিয়াগো গার্সিয়া ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, তবে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করা হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, বিষয়টি ইঙ্গিত দেয়, যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত ও একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক তৎপরতা এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা সর্বোচ্চ চূড়ায়। দুই দেশই নানা বক্তব্য ও হামলার হুমকি দিয়ে চলেছে। বিশেষ করে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়ায় ইসরায়েল বারবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, তারা প্রয়োজনে আগাম প্রতিরোধমূলক হামলা চালাতে পারে।
এই উত্তেজনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের এমন সামরিক প্রস্তুতি কেবল ইরান নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই উদ্বেগের বার্তা। কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে—এই পদক্ষেপ কি শুধুই চাপ প্রয়োগ, নাকি সত্যিই বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে?
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই প্রায় ৪ হাজার মার্কিন সেনা মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন রয়েছে। শুধু যুদ্ধবিমান বা রণতরী নয়, স্থলবাহিনীও যেন অপেক্ষায় আছে বড় কোনো সামরিক অভিযানের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই কৌশলগত অগ্রগতি ইরানের ওপর চাপ বাড়ানোর একটি বড় কৌশল। তবে চাপ প্রয়োগের মাঝেই যদি ইরান বা ইসরায়েল ভুল করে বসে, তাহলে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি মুহূর্তেই রূপ নিতে পারে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে।
বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক মহল, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এবং সাধারণ মানুষ—সবাই এখন তাকিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশের দিকে। প্রতিদিনই সেই আকাশে বাড়ছে যুদ্ধবিমান, নেমে পড়ছে নতুন রণতরী।