close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

জীবিত ব্যক্তিকে জুলাই আন্দোলনে ‘শহীদ’ দেখিয়ে হ'ত্যা মামলা!..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
মরেনি, তবু শহীদ! ময়মনসিংহের সুলাইমান সেলিম জানতে পারেন, তাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে করা হয়েছে হত্যা মামলা—আর সেই মামলার বাদী তারই বড় ভাই! সরকারের বিরোধিতায় দায়েরকৃত এ ঘটনায় উঠে এসেছে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র ও মানবাধিকার..

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি ঘটনা মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সুলাইমান সেলিম নামের এক ব্যক্তি হঠাৎ করেই জানতে পারেন—তাকে মৃত দেখিয়ে রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানায় করা হয়েছে হত্যা মামলা!
আর এই মামলা করেছেন তারই আপন ভাই মোস্তফা কামাল। যে মামলায় সেলিমকে 'জুলাই আন্দোলনের' সময় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

“আমি বেঁচে আছি, অথচ সরকার বলছে আমি মরে গেছি!”

সেলিম বলেন, “খুব কষ্ট, খুব কষ্ট ভিতরে। যদি বুক ছিড়া দেখাইতে পারতাম... আমি বেঁচে থাকতে মৃত বানায়া হামার বড় ভাইয়ে দেখাইছে সরকারেরে যে আমি মরে গেছি! এর চাইতে বড় দুঃখ পৃথিবীতে কী আছে?” — বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

ঘটনার সূত্রপাত গতবছরের ৩১ আগস্ট, যখন ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ির কাজলা এলাকায় সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে ‘মৃত’ হিসেবে সেলিমকে দেখিয়ে তার ভাই মামলাটি দায়ের করেন, যার প্রধান আসামি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য আসামিদের তালিকায় আছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ৪১ জন এবং অজ্ঞাত ১৫০-২০০ জন।

নিজের বেঁচে থাকা প্রমাণে ৫ বার হাজিরা দিলেন সেলিম!

ভাইয়ের করা মামলায় নিজের নাম দেখে হতবাক সেলিম এরপর থেকে নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে দৌড়াতে থাকেন ঢাকার আদালত, ডিবি অফিস এবং যাত্রাবাড়ি থানায়। এখন পর্যন্ত তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে ৫ বার হাজিরা দিয়েছেন বিভিন্ন দপ্তরে।

তিনি বলেন, “চারবার গেছি যাত্রাবাড়ি থানা, একবার গেছি ডিবি অফিসে। এই মামলাটা করছে শুধু আমাকে মাইরা ফেলার জন্য। যদি এর মাঝে পুলিশ জানার আগেই মাইরা ফেলত, তাহলে তো আমি হইতাম সরকারি লাশ!”

প্রাণভয়ে দিন কাটাচ্ছেন সেলিম, আতঙ্কে গোটা গ্রাম!

ফুলবাড়িয়ার ধামর এলাকায় এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে আতঙ্ক ও ক্ষোভ। সেলিম জানান, তিনি এখন আর নিরাপদ বোধ করছেন না। সারাক্ষণ আশঙ্কা করছেন, কখন তাকে হত্যা করে ‘তথাকথিত শহীদের’ তালিকায় চূড়ান্তভাবে ঠেলে দেওয়া হবে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে—এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। তিনি বলেন, “জীবিত একজন মানুষকে মৃত দেখিয়ে তার ভাই মামলা করেছে—এটি কল্পনার বাইরে। এ ঘটনা শুধু একজন মানুষকে নয়, বরং পুরো শহীদ তালিকাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।”

তিনি আরও বলেন, “হুকুমের আসামি হতে পারে, কিন্তু উপস্থিত না থেকেও গুলি চালানোর আসামি বানানো, সাংস্কৃতিককর্মী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়া—এসব স্পষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এতে একদিকে হয়রানি, অন্যদিকে মামলার নামে চাঁদাবাজির অভিযোগও উঠছে।”

আইনজীবীর বক্তব্য: ইচ্ছাকৃতভাবে মামলাকে দুর্বল করার প্রবণতা চলছে

মানবাধিকার আইনজীবী এলিনা খান বলেন, “সত্যিকারের অপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু নিরীহ, সাধারণ মানুষদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে মামলাকে দুর্বল করার প্রবণতা ভয়াবহ। এটা বন্ধ করতে না পারলে রাষ্ট্রের আইনপ্রণয়ন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।”

তিনি আরও বলেন, “যারা এ ধরণের ভুয়া মামলা করছে, তারাও আইনের আওতায় আসা উচিত। বিচার না হলে এই প্রবণতা থামবে না।”


জুলাই-আগস্ট আন্দোলন: শহীদ না নাটক?

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে দায়ের হয়েছে দেড় হাজারের মতো মামলা, যার মধ্যে প্রায় ৬০০টি হত্যা মামলা। অথচ, এসব মামলায় আসামি হচ্ছেন অভিনেত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, এমনকি যাদের ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকার কোনো প্রমাণই নেই।

সেলিমের ঘটনা: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ফাঁকফোকর উন্মোচন

সেলিমের ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি বর্তমান বিচারিক প্রক্রিয়ার ভয়াবহ ফাঁকফোকরকে স্পষ্ট করে দেয়। মামলার বাদী এখন পলাতক। তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, আদালতের নির্দেশে ডিএনএ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে সেলিম সত্যিই জীবিত কি না!

এদিকে যাত্রাবাড়ি থানা জানিয়েছে, মামলা এখনও রুজু অবস্থায় রয়েছে এবং তদন্ত করছে ডিবি।


একটি প্রশ্ন: কারা চালাচ্ছে এই মামলার কারখানা?

এই প্রশ্ন এখন অনেকের মনে—এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড, অথচ ভুক্তভোগী নিজেই বেঁচে আছে! তাহলে মামলা কার স্বার্থে, কেনই বা তার ভাই এমন কাজ করলেন?

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব মামলার অনেকগুলোতেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে—ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এমন মানুষদের নাম দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে। একদিকে নিরীহ মানুষ বিপদের মুখে পড়ছেন, অন্যদিকে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে থেকে যাচ্ছেন।

সুলাইমান সেলিম এখন কেবল একজন মানুষ নয়—তিনি প্রতীক হয়ে উঠেছেন এ যুগের বিচারহীনতার, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার। তার প্রশ্ন—“আমি বেঁচে থাকতে কেন আমাকে মরা বানানো হলো?”—এ প্রশ্ন আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার সামনে একটি আয়না ধরেছে।

সেলিমের মতো আরও কতজন আছেন, যারা হয়তো এখনো জানেন না তারা ‘মরে’ গেছেন।

Tidak ada komentar yang ditemukan