বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দল জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এসেছে এক যুগান্তকারী বার্তা। দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি 'ঠিকানা টিভি'-এর একটি টকশোতে অংশ নিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে 'নীতিগত মোড় ঘোরানো' ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তিনি টকশোতে বলেন, "শুধু একাত্তর নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যদি আমাদের দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি তাঁদের কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাই।" তাঁর এই বক্তব্য যেন বহুদিন ধরে জমে থাকা রাজনৈতিক অপরাধবোধের এক আবেগঘন স্বীকারোক্তি।
ডা. শফিক বলেন, মানুষ যেমন ব্যক্তি হিসেবে ভুল করে, তেমনই রাজনৈতিক দলও ভুল করতে পারে। দল হিসেবে Jamaat-এর অতীত সিদ্ধান্তগুলো যে সর্বদা নিখুঁত ছিল না, সে বিষয়েও তিনি খোলামেলা মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, আজ যা ভুল বলে ধরা হচ্ছে, কাল হয়তো সেটিই ইতিহাসে সঠিক হিসেবে স্থান পাবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, তাঁর এই ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই, বরং এটি তাঁর মানবিকতা ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই এসেছে। "আমি কোনোরূপ শর্ত ছাড়াই ক্ষমা চেয়েছি। মানুষ হিসেবে আমাদের ভুল হতেই পারে, এবং যদি কারও কষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের মাফ চাওয়ার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।"
এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে একটি বড় রাজনৈতিক বার্তা। দেশের রাজনৈতিক মহলে অনেকেই মনে করছেন, জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে যে "কঠোর অবস্থানে" ছিল—তার চূড়ান্ত প্রকাশ এটাই হতে পারে।
টকশোর আরেক অংশে দলীয় জোট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যদি ভবিষ্যতে ভোটে জোটগত অংশগ্রহণ হয়, তবে প্রয়োজনে শরিক দলকে নিজের প্রার্থিতা ত্যাগ করে আসন ছেড়ে দেওয়ার জন্যও তিনি প্রস্তুত। "এটি দলের মধ্যে জানিয়ে রাখা হয়েছে,"—বলেছেন তিনি।
এই বক্তব্য থেকে ধারণা করা হচ্ছে, জামায়াত আগের মতো কেবল নিজের অবস্থান রক্ষায় নেই, বরং বৃহত্তর কৌশলের অংশ হতে চায়। শরিকদের গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতির নতুন ধারা অনুসরণে তারা আগ্রহী।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, "প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে আমরা সক্রিয়ভাবে কথা বলছি।" তিনি আরও বলেন, "বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের নিজেদের ভোটের অধিকারের জন্য সোচ্চার হতে হবে। এটি শুধু গণতন্ত্র নয়, জাতীয় দায়িত্বও।"
জামায়াতের পক্ষ থেকে অতীতে প্রবাসীদের ভোটের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে অনেকের ধারণা। এই প্রথম দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মুখ থেকে বিষয়টি জোর দিয়ে বলা হলো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধুই এক ব্যক্তির বক্তব্য নয়—বরং এটি হতে পারে জামায়াতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশলের ইঙ্গিত। বিশেষ করে দলটির অতীত কর্মকাণ্ড, ১৯৭১ সালের ভূমিকা এবং বর্তমান রাজনীতিতে টিকে থাকার লড়াইয়ে এটি একটি কৌশলগত 'পিভট মোমেন্ট'—যা নতুন দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করতে পারে।
কেউ কেউ মনে করছেন, এই ক্ষমা চাওয়া কেবলমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কৌশল হতে পারে, তবে অনেকেই এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। অন্তত একবারের জন্য হলেও একটি রাজনৈতিক দল তার ভুল স্বীকার করছে—এটিই বড় কথা।
ডা. শফিকুর রহমানের এই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য হয়তো রাতারাতি সবকিছু পাল্টে দেবে না। তবে এটি নিঃসন্দেহে রাজনীতির মাঠে একটি নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সময়ই বলবে, ক্ষমা চাওয়ার এই সংস্কৃতি সত্যিই দলটির ভিতরে কোনো আমূল পরিবর্তন এনেছে কিনা, নাকি এটি শুধুই সময়ের চাহিদা পূরণের একটি রাজনৈতিক মেকানিজম।