গাজা যুদ্ধের দুই বছরের বেশি সময় পর অবশেষে শান্তির পথে এক নতুন মোড় এনেছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া ২০ দফার শান্তি পরিকল্পনায় শর্তসাপেক্ষ ‘হ্যাঁ’ জানিয়েছে তারা। ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধ শেষ করতে একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ ঘোষণা করেন এবং হামাসকে ৫ অক্টোবরের মধ্যে সাড়া দেওয়ার আলটিমেটাম দেন। তিনি স্পষ্ট করে দেন, সময়সীমার মধ্যে সম্মতি না দিলে ‘নরক নেমে আসবে’। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই ৩ অক্টোবর হামাস চমকপ্রদ এক বার্তা পাঠায়।
হামাসের এই বার্তায় তারা প্রথমবারের মতো সম্মতি জানায় যে, ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি গাজা ছাড়ার আগেই ৪৮ জন বন্দীর সবাইকে মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে গাজার প্রশাসন একটি টেকনোক্র্যাট সরকারের হাতে যাওয়ার বিষয়েও তারা সম্মত হয়। তবে অস্ত্র সমর্পণ করবে কি না বা গাজা থেকে নিজেদের রাজনৈতিক উপস্থিতি তুলে নেবে কি না—এই সংবেদনশীল প্রশ্নে তারা নীরব থাকে। বরং তারা জানিয়েছে, বন্দী মুক্তির বিষয়টি নিয়ে ‘বিস্তারিত আলোচনা’ দরকার। এতে বোঝা যাচ্ছে, হামাস মূল পরিকল্পনার অনেকটাই এড়িয়ে গিয়ে নিজের অবস্থান অটুট রাখতে চাইছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য হামাসের এই বার্তাকে ইতিবাচক সাড়া হিসেবেই নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, “হামাস স্থায়ী শান্তির জন্য প্রস্তুত।” তিনি ইসরায়েলকে নির্দেশ দেন গাজায় বোমাবর্ষণ অবিলম্বে বন্ধ করতে, যাতে বন্দিবিনিময়ের পথ তৈরি হয়। কিন্তু ইসরায়েল সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে নতুন করে বিমান হামলায় ২০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে।
এই পরিস্থিতিতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কঠিন এক অবস্থানে পড়ে গেছেন। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সাড়া দিতে না চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়বে, আবার দ্রুত শান্তি চুক্তি না করলে যুদ্ধক্লান্ত ইসরায়েলি জনগণের চাপ বাড়বে। সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনার পক্ষে ৭২ শতাংশ ইসরায়েলি নাগরিক সমর্থন জানিয়েছেন। হামাসের প্রতিক্রিয়ার পর গাজার ২০ লাখের বেশি মানুষ যুদ্ধবিরতির আশায় উল্লাস প্রকাশ করেছে।
তবে আশার আলো জ্বালালেও মূল বাধাগুলো এখনও অমীমাংসিত। বন্দী মুক্তি নিয়ে দ্রুত চুক্তি সম্ভব হলেও অস্ত্র সমর্পণ, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার প্রশাসন এবং ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার ইত্যাদি বড় ইস্যুগুলো ঝুলে আছে। হামাস স্পষ্ট করেছে, তারা বন্দী মুক্তি দেবে ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের লক্ষ্যেই। কিন্তু ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বন্দী মুক্তির পর ইসরায়েল গাজার কিছু অংশ ছাড়বে এবং সীমান্তে একটি ‘বাফার জোন’ রাখবে। এতে হামাসের আশঙ্কা, বন্দী মুক্তির পর ইসরায়েল আবার যুদ্ধ শুরু করতে পারে, যেমনটি মার্চ মাসে হয়েছিল।
এবার হামাস আগেভাগেই কাতারি মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছে। তাদের মূল শর্ত দুটি—এক, বন্দী মুক্তির পর যুদ্ধ যেন পুনরায় শুরু না হয়, এবং দুই, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে হবে। হামাসের সামরিক শাখা বিশেষ করে এ বিষয়ে বেশি সতর্ক, কারণ বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার পর তাদের চাপ প্রয়োগের অস্ত্র কমে যাবে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার পুনর্গঠনের জন্য একটি “বোর্ড অব পিস” গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে টনি ব্লেয়ারের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং আরব দেশগুলো শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাবে। হামাসকে অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে এবং প্রশাসনে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। কিন্তু হামাস এসব প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা প্রস্তাব দিয়েছে, প্রশাসন গঠন করবে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের একটি সংস্থা’, এবং তারা আলোচনায় অংশ নিতে চায়। ভারী অস্ত্র হস্তান্তরের ইঙ্গিত দিলেও হালকা অস্ত্র রাখতে চায় তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, হামাস এখন ইসরায়েলের জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির কৌশলই অনুসরণ করছে। ইসরায়েল তখন তিন ধাপের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সম্মতি দিয়েছিল, কিন্তু বাকিগুলো বাস্তবায়ন করেনি। এতে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হন, কারণ অনেক বন্দীর অবস্থা তখন আশঙ্কাজনক ছিল এবং হামাস তাদের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করেছিল। এবার হামাস একই কৌশল ব্যবহার করে ধাপে ধাপে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে।
পরিস্থিতি এখন অনেকটাই ট্রাম্পের কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর নির্ভর করছে। তিনি যদি উভয় পক্ষকে আশ্বস্ত করতে পারেন এবং চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম হন, তবে শান্তির প্রক্রিয়া বাস্তবে রূপ নিতে পারে। অন্যথায়, আলোচনায় বিলম্ব হলে তার আগ্রহ দ্রুত কমে যেতে পারে এবং যুদ্ধের আগুন আবারও জ্বলে উঠতে পারে।
তবে সব জটিলতার মধ্যেও আশার আলো রয়েছে। তিন বছরে পা দিতে যাওয়া এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কাছে এসেছে। যুদ্ধ থামানো ও বন্দী মুক্তি এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। সেই লক্ষ্য পূরণে সাময়িক হলেও উভয় পক্ষের নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। হামাস জানিয়েছে, তারা আলোচনায় অংশ নিতে প্রস্তুত এবং ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে সম্মত। এখন সময়ই বলে দেবে, এই ঐতিহাসিক সুযোগ শান্তির পথে এগিয়ে নিতে পারে কি না।