যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোটের অস্থিরতা: ইরানকে ঘিরে ধ্বংসের ছক?
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাস শুধু উত্তেজনাময়ই নয়, রীতিমতো বিস্ফোরণঘন। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল, সেটি ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক অনিবার্য সংঘাতের দিকে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই টানাপোড়েন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের উদ্বেগ এবং সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত বর্তমান ভূ-রাজনীতিকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি: শান্তি না শত্রুতা?
ইরান শুরু থেকেই দাবি করে আসছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক চুক্তি—Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA)—মধ্য দিয়ে ইরান ও বিশ্বের ছয়টি শক্তিধর রাষ্ট্র একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম সীমিত রাখবে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শন মেনে চলবে। এর বিনিময়ে তারা নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাবে।
কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে একতরফা সরে গিয়ে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর ফলে ইরান পুনরায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে থাকে, যা এখন ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে—যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট। এই পদক্ষেপ পশ্চিমা বিশ্বকে চরমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
‘সর্বাধিক চাপ’ কৌশল: আলোচনার ছদ্মবেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি?
চুক্তি বাতিলের পর, ট্রাম্প যে কৌশল গ্রহণ করেন, তা পরিচিত ‘ম্যাক্সিমাম প্রেসার’ হিসেবে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে আলোচনায় বাধ্য করা। তবে বাস্তবে এর ফল হয়েছে উল্টো। ইরান আরও আগ্রাসীভাবে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এবং কোনো আলোচনার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ট্রাম্প পরমাণু আলোচনার প্রস্তাব দিলেও সেই প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল সামরিক হুমকি। ইরান তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তারা বারবার যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে এবং আর কোনো চাপ বা হুমকিতে তারা নত হবে না।
ইসরায়েল: ছায়ার নায়ক নাকি উসকানির কারিগর?
ইসরায়েল এই সংকটের অন্যতম মূল চরিত্র। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার দাবি করে আসছেন, ইরান যদি পরমাণু কর্মসূচি না বন্ধ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি লিবিয়ার উদাহরণ টেনে ইরানকে হুমকি দিয়েছেন, কিন্তু ইরান লিবিয়ার মতন আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি কূটনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে। তবে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো পাহাড়ের গভীরে গোপনে নির্মিত হওয়ায় একক হামলায় তা ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। এই কারণে বিশেষ বাহিনীর সহায়তা কিংবা একাধিক দফায় সামরিক হামলার প্রয়োজন হতে পারে।
যুদ্ধের বিপক্ষে আমেরিকানদের প্রতিবাদ
যদিও হোয়াইট হাউজ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, মার্কিন জনগণের একটি বড় অংশ এই সম্ভাব্য সংঘাতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কনজারভেটিভ, প্রোগ্রেসিভ ও লিবারটেরিয়ানদের একটি বড় অংশ মনে করে, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ আমেরিকার জন্য আত্মঘাতী হবে। ফক্স নিউজের বিশ্লেষক টাকার কার্লসন সতর্ক করেছেন, ‘ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ হলে হাজার হাজার আমেরিকান প্রাণ হারাবে, যা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।’
এছাড়া প্রগতিশীল গোষ্ঠী 'কোডপিংক' স্পষ্ট ভাষায় বলেছে—এই যুদ্ধ কেবল ইসরায়েলের লাভের জন্য, আমেরিকার জন্য নয়।
সামরিক প্রস্তুতির ছায়ায় কূটনীতির মুখোশ
একদিকে কূটনৈতিক আলোচনার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে উন্নত যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বোঝাই যাচ্ছে, সামরিক পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।
ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, “চুক্তি না হলে, সামরিক পদক্ষেপ হবে।” তিনি আরও বলেছেন, “যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে ইসরায়েল সেই পদক্ষেপে নেতৃত্ব দেবে।” এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, ইসরায়েল শুধু অংশীদার নয়, বরং এই যুদ্ধে মুখ্য ভূমিকায় থাকতে চায়।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বর্তমান দ্বন্দ্ব শুধু দুই দেশের নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্য একটি ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইরাক যুদ্ধের ফলাফল যেমন ভয়াবহ ছিল, ইরানের ক্ষেত্রেও তা ভিন্ন হবে না।
এখন সময় এসেছে কূটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার। কারণ যুদ্ধ শুরু হলে তা থামানো অসম্ভব হবে এবং বিশ্ব হয়তো আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যদি সত্যিই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চায়, তবে ইরানের সঙ্গে সম্মানের ভিত্তিতে আলোচনার বিকল্প নেই।