ইরাকের একটি গোপন গুহায় অভিযানে গিয়ে মিথেন গ্যাসে প্রাণ হারাল তুরস্কের ১২ সৈন্য। সংঘাত থামাতে আলোচনার মাঝেই এই ট্র্যাজেডি দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে।
তুরস্কের উত্তর ইরাকের একটি গুহায় বিশেষ অভিযানে অংশ নিতে গিয়ে মিথেন গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ১২ তুর্কি সেনার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (১ জুলাই) দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই তথ্য নিশ্চিত করে জানায়, সেনারা গুহায় প্রবেশ করার পরপরই গ্যাসে আক্রান্ত হন এবং ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজন মারা যান।
তুরস্কের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এই অভিযানটি ছিল ২০২২ সালে কুর্দি যোদ্ধাদের হামলায় নিহত এক সেনার মরদেহ উদ্ধারে পরিচালিত অনুসন্ধানের অংশ। ইরাকের পাহাড়ি উত্তরাঞ্চলে থাকা একটি গুহায় সে সময় পিকেকে (কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি)-র সদস্যদের গুলিতে নিহত হন ওই সেনা। দীর্ঘ সময় পরও তার মরদেহ উদ্ধার সম্ভব না হওয়ায় সেনাবাহিনী ফের অভিযান শুরু করে।
এ অভিযানের সময় সেনারা মিথেন গ্যাসে আক্রান্ত হন। ঘটনাস্থলে নিহত হন অনেকে, পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ জনে। যদিও এখনো পরিষ্কার নয়—গুহাটিতে মিথেন গ্যাস কীভাবে তৈরি হয়েছিল, সেটা প্রাকৃতিক কারণে নাকি শত্রুপক্ষের কৌশল ছিল। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
এমন এক সময়ে এই ঘটনা ঘটলো, যখন তুরস্ক ও কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠী পিকেকে-র মধ্যে নতুন করে আলোচনার উদ্যোগ চলছে। পিকেকে ইতোমধ্যেই দীর্ঘদিনের সশস্ত্র আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি থেকে কিছুটা সরে এসে এখন সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকারের দিকে জোর দিচ্ছে।
তবে তুরস্কের সরকার এখনো পিকেকে-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই দেখে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও একে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। ১৯৮৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪০ হাজার মানুষ।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “মিথেন গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে আমাদের আরও চারজন বীর সেনা সহকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন, ফলে এই অভিযানে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ জনে।” এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তুরস্কজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে সমবেদনা প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক এবং প্রবাসীরা।
এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে—অভিযানের আগে কি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল? কিভাবে গ্যাসের উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য জানা গেল না, কেন সেনারা সরাসরি বিপজ্জনক অঞ্চলে প্রবেশ করলেন? অনেকেই বলছেন, এই দুর্ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং গোয়েন্দা ব্যর্থতার ইঙ্গিতও বহন করে।
সরকারিভাবে এখনও পুরো ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হতে পারে এবং বিশেষ করে গুহা বা ভূগর্ভস্থ অভিযানে আরও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।
বর্তমানে নিহত সেনাদের দাফন ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শ্রদ্ধা জানানোর প্রস্তুতি চলছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ব্যক্তিগতভাবে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং নিহত সেনাদের পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই ঘটনা শুধু তুরস্কে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এমন অভিযানে নিরাপত্তার ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং সেনাদের প্রাণহানিকে ‘এড়ানো যেত’ এমন দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা বলে অভিহিত করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি জাগরণবার্তা—সেনা অভিযান শুধু শক্তি নয়, সতর্ক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সমন্বয়ে হওয়া উচিত। নইলে এমন প্রাণহানির ঘটনা ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হতে পারে