ইরানে সাম্প্রতিক মার্কিন হামলার পর হঠাৎ করেই বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে “সরকার পরিবর্তন” ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এক বিস্ফোরক পোস্টে ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন—
যদি ইরানের বর্তমান সরকার দেশটিকে আবার মহান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেখানে সরকার পরিবর্তন হবে না কেন?
ট্রাম্পের এমন মন্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইরানে একটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা নিয়ে হয়তো আগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটে হেগসেথ এ দাবিকে নাকচ করে বলেন, “এই অভিযান ছিল পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের লক্ষ্যে, সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নয়।”
তবে ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বলছে ভিন্ন কথা।
জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির সাইয়েদ ইরাভানি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কড়া অভিযোগ তুলে বলেন,
“ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে ইরানে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি অগ্রহণযোগ্য আগ্রাসন।”
চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং বলেছেন, “বেইজিং এই হামলার তীব্র নিন্দা জানায়।”
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়াও বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র একটি ভয়াবহ ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে দিয়েছে।”
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস “আরও একটি ধ্বংসযজ্ঞের চক্র বন্ধে” বিশ্বনেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (IDF) জানিয়েছে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে বহু জায়গায় সাইরেন বাজানো হচ্ছে। রবিবার সকালে ইরান একযোগে অন্তত ২৭টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। লক্ষ্যবস্তু ছিল তেল আবিব, হাইফা, নেস জিওনা ও রিশন লেজিওন।
তীব্র ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বহু আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে।
এর জবাবে ইসরায়েল হামলা চালায় ইরানের রাজধানী তেহরান, কেরমানশাহ ও হামেদানে। লক্ষ্যবস্তু ছিল রাডার সিস্টেম, স্যাটেলাইট ঘাঁটি এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ স্থান। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, ইরানের বহু সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়ার সাথে সাথে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে ৩ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৭৯ ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সরবরাহ চেইনে বড়সড় বিঘ্ন ঘটবে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে।
ট্রাম্প তার পোস্টে দাবি করেছেন—সরকার পরিবর্তন শব্দটি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যদি কেউ তার দেশকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়, তবে তাকে বদলানোই যৌক্তিক।
এই বক্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও তৈরি হয়েছে বিভাজন।
রিপাবলিকানদের বড় একটি অংশই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ এবং সরকার পরিবর্তন বিষয়ক উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ইরাক যুদ্ধের সময় জর্জ ডব্লিউ বুশের ভুল সিদ্ধান্তকে, যেখানে “মানববিধ্বংসী অস্ত্র” থাকার অজুহাত দিয়ে ইরাক আক্রমণ করা হলেও পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানে মার্কিন হস্তক্ষেপ শুধু একটি কূটনৈতিক ইস্যু নয়— বরং এটি ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরও একটি কৌশলী পদক্ষেপ।
ট্রাম্প আসন্ন নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ চাপ সামাল দিতে চাইছেন আন্তর্জাতিক সফলতা দেখিয়ে। এর ফলস্বরূপ, ইরান এখন পরিণত হয়েছে একটি ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছকে— যেখানে প্রতিপক্ষ ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও জাতিসংঘ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।
মধ্যপ্রাচ্য আবারও একটি অস্থির, অনিরাপদ ও যুদ্ধপ্রবণ অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।
ট্রাম্পের “সরকার পরিবর্তন” মন্তব্য কেবল ইরান নয়, পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে।
এই সংঘাত চলতে থাকলে এর প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়— বরং সারা বিশ্বে পড়বে, বিশেষ করে বিশ্ব অর্থনীতি, জ্বালানি বাজার এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে।