তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সবার জন্য হলেও দায় নেওয়ার সময় সবাই পিছিয়ে যায়। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল পর্যন্ত– সবাই সুবিধা নেয়, কিন্তু দায়ের বোঝা সরকারের কাঁধেই থেকে যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি ও জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান উপলক্ষে গণমাধ্যমে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জের কথা খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম। তিনি স্বীকার করেছেন, সরকার সবার হলেও এর দায়ভার নিতে কেউ এগিয়ে আসে না, অথচ সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে সবাই আগ্রহী।
মাহফুজ আলম বলেন, অভ্যুত্থানের আগে যে পাঠচক্র ও চিন্তাভাবনা ছিল, সেখানে একটি সুস্পষ্ট রাষ্ট্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছিল—রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করবে, তার একটি পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাস্তবে অন্তর্বর্তী সরকার একটি ঐকমত্যভিত্তিক ব্যবস্থা, যেখানে সব পক্ষই জড়িত। এর শক্তি হলো সবার অংশগ্রহণ, আবার দুর্বলতাও এখানেই—কারণ সবাই দাবি করে, সুবিধা নেয়, কিন্তু দায়ের জায়গায় নীরব থাকে। দিন শেষে সরকারের কাঁধেই সব দায়িত্ব এসে পড়ে।
তিনি আরও জানান, রাষ্ট্র সংস্কারের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটি এখনও চলছে এবং এর অগ্রগতি হয়েছে। ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, যদি এই ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।
জুলাই অভ্যুত্থানের কর্মসূচি নিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, আন্দোলনের ভাষা শুধু শব্দের বিষয় নয়, বরং এর মধ্যে বক্তব্য, কৌশল এবং ঐক্যের বার্তা থাকে। শাপলা ও শাহবাগের সময়কার সেক্যুলার-ইসলামিস্ট দ্বন্দ্ব ভেঙে একটি অভিন্ন ভাষা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল, যা বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে একত্র করেছিল। এই অভিন্ন ভাষা কোনো ব্যক্তির একক সৃষ্টি নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে তিনি বলেন, এটি শুধু রাজনীতি নয়—সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আদর্শ ও ক্ষমতার কাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করে। সামরিক, বেসামরিক ও আমলাতান্ত্রিক ত্রিভুজ এবং গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক অভিজাত শ্রেণি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষমতার সম্মিলনেই দীর্ঘদিনের নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা টিকে ছিল। এসব পরিবর্তন ছাড়া আসল সংস্কার সম্ভব নয়, কেবল উপরিভাগে প্রলেপ দেওয়ার মতো পরিবর্তন হবে।
ছাত্র নেতৃত্বে দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, বড় কোনো আন্দোলনে কিছু বিচ্যুতি থাকতেই পারে, কিন্তু ছাত্রদের নিখাদ স্পিরিট এখনও আছে। সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা ও কর্মসূচি পেলে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন কমে যাবে।
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে মাহফুজ আলম বলেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের শক্তিমত্তা সীমিত হওয়ায় সংস্কার বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যের মাধ্যমে সংস্কারে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের অগ্রগতি নিয়ে তিনি জানান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন ও সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিটিভি, বেতার ও বাসসকে আধুনিকায়ন এবং জনপ্রিয় কনটেন্ট ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে।
বিদেশি অপপ্রচার মোকাবিলায় ‘বাংলা ফ্যাক্ট’ টিমের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই ফ্যাক্ট-চেকিং জোরদার করা জরুরি।
সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি ফেসবুকে দেওয়া নিজের পোস্ট প্রসঙ্গে এক-এগারোর প্রতিধ্বনি শোনার মন্তব্যের বিষয়ে আর কথা বলতে চাননি। তবে শেষ কথায় তিনি জানান, বর্তমানে সরকারের দায়িত্ব শেষ করার ওপরই মনোযোগ দিচ্ছেন, এরপর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববেন।