দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতেই হাজারো ফিলিস্তিনি ফিরছেন নিজেদের ভাঙা ঘরে। ঘর নেই, ছাদ নেই, তবুও শান্তির আশায় তারা ফিরছেন জন্মভূমিতে—যেখানে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও জ্বলছে জীবনের আশা।
গাজায় অবশেষে নেমে এসেছে একটুখানি শান্তি। টানা দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি। এই যুদ্ধবিরতির খবর শুনে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে ফিলিস্তিনিরা। হাজারো মানুষ এখন ফিরে যাচ্ছেন তাদের ভিটেমাটিতে—যে ঘরগুলো আজ কেবল ধ্বংসস্তূপ, পোড়া দেয়াল আর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির স্তূপ।
দুই বছরের এই যুদ্ধে গাজাবাসীর জীবন হয়ে উঠেছিল এক অনন্ত দুঃস্বপ্ন। মৃত্যু, ধ্বংস আর বাস্তুচ্যুতির মধ্যে দিয়ে তারা হারিয়েছে প্রিয়জন, ঘরবাড়ি ও জীবনের নিরাপত্তা। অনেকে বারবার আশ্রয় বদলেছেন, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এখন সেই মানুষগুলোই আবার ফিরে যাচ্ছেন, যেন নিজেদের ভাঙা ঘর ছুঁয়ে কিছুটা শান্তি খুঁজে নিতে পারেন।
গাজার দক্ষিণাঞ্চল খান ইউনিসের বাসিন্দা আমির আবু ইয়াদে বলেন, “আমরা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে অন্তত এখন ফিরতে পারছি। আমাদের ঘর ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু নিজেদের মাটিতে পা রাখার সুখের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না।”
অন্যদিকে গাজার কেন্দ্রীয় শহরের ৩৯ বছর বয়সী মুহাম্মদ মুর্তজা বলেন, “আমি প্রার্থনা করেছি যেন ফিরে গিয়ে দেখি আমার বাড়ি টিকে আছে। কিন্তু জানি, অনেকের মতো আমার ঘরও হয়তো গুঁড়িয়ে গেছে। তবু ফিরে যাচ্ছি, কারণ এটাই আমার ঘর, আমার পরিচয়।”
৫৩ বছর বয়সী আরিজ আবু সাদায়েহ বলেন, “আমি এই যুদ্ধে আমার এক ছেলে আর এক মেয়েকে হারিয়েছি। এই বেদনা সারাজীবন থাকবে। কিন্তু অন্তত এখন ঘরে ফিরছি—এই অনুভূতি আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে।”
এই যুদ্ধবিরতি সম্পন্ন হয়েছে মিসরের শারম আল শেখে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হিসেবে এই চুক্তিকে দেখা হচ্ছে। শুক্রবার ভোরে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয় এবং একই দিন সকাল থেকেই তা কার্যকর হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার নির্দিষ্ট এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। অপরদিকে, হামাস সোমবারের মধ্যে জীবিত সব জিম্মিকে মুক্তি দেবে এবং এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দেবে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, চুক্তি কার্যকরের পর ইসরায়েল ইতোমধ্যে গাজার কয়েকটি অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে দেখা যায়, হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার উত্তরাঞ্চলে ফিরে যাচ্ছেন—যে এলাকায় সাম্প্রতিক বোমা হামলায় এক সময় ঘরবাড়ি পর্যন্ত ছিল না।
চুক্তি অনুসারে, প্রতিদিন প্রায় ৬০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করবে। এসব ট্রাক খাদ্য, ওষুধ ও পুনর্গঠনের সরঞ্জাম বহন করবে। তবে বাস্তবে এই সরবরাহ কতটা নির্বিঘ্নে হচ্ছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
যুদ্ধের ক্ষত এখনো শুকায়নি। গাজার মাটি আজও পোড়া, ধূলায় মিশে গেছে অগণিত স্বপ্ন। তবু গাজাবাসীরা ফিরছে। কারণ, যত ভাঙাচোরা হোক, সেই মাটিই তাদের ঘর, সেই ধ্বংসস্তূপই তাদের আশা, তাদের বেঁচে থাকার প্রতীক।