দুই উপজেলার থেমে নেই মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব, বিপাকে গ্রামবাসীরা..

Imran Hossain avatar   
Imran Hossain
হাতির বিরুদ্ধে থানায় শতাধিক জিডি

আনোয়ারা-কর্ণফুলী:

দুই উপজেলার থেমে নেই মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব, বিপাকে গ্রামবাসীরা

থেমে নেই মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব। বিপাকে দেয়াঙ পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতির তান্ডবে অতিষ্ঠ গ্রামবাসীরা। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী দুই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগুলোতে বন্যহাতির তান্ডব চলছে প্রতিনিয়ত। গত প্রায় দুই যুগ ধরে বন্যহাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে গ্রামগুলো।

যে পথে একবার আসে, সেই পথে শত বছর পর হলেও ফিরে আসে। হাতির স্মৃতিশক্তি এমনই প্রখর বলে জানিয়েছে প্রাণি গবেষকরা। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে বন কেটে গড়ে উঠছে লোকালয়। এতে নিজেদের আবাসস্থল খুঁজে না পেয়ে প্রতিশোধ হিসেবে বন্যহাতি প্রায়ই মানুষের ওপর তাণ্ডব চালাচ্ছে বলে মন্তব্য হাতি গবেষকদের।

জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসস্থল তৈরি করতে গিয়ে কক্সবাজারে হাতির অভয়ারণ্য এলাকার বন-জঙ্গল নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ফলে চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, বোয়ালখালী, লোহাগাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে গত ৭ বছর আগে চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী দেয়াঙ পাহাড়ে আসছে একটি হাতির পাল।

৭ বছর ধরে অবস্থান করছে ৫টি হাতির একটি দল দিনে জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলেও রাত নামতেই খাবারের খোঁজে তারা হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। রাতভর তাণ্ডব চালিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই হাতির পাল ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। সামনে কাউকে পেলেই করে আক্রমণ।

সম্প্রতি যে এলাকা গুলোতে হাতি আসছে, আগে কখনও এমন বিচরণ দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। হঠাৎ হাতির মুখোমুখি হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন মানুষ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিদিনই পাহাড় থেকে বন্যহাতির দল গ্রামবাসীর জমির ফসল, ঘর-বাড়ি ও গাছ-পালার ক্ষতি করছে। গত ৬ বছর পাঁচটি হাতি আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে। হাতিগুলো কখনও দিনে আবার কখনও রাতে লোকালয়ে নেমে আসে। ওই এলাকা থেকে হাতি সরিয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বনবিভাগও। এতে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি বাড়ছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

হাতির আক্রমণে ৭ বছরে ১৭ জনের মৃত্যু:
আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ের আশপাশের এলাকায় গত ৭ বছরে হাতির আক্রমণে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে উপজেলার বড়উঠানের শাহমীরপুর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের টেনরুলের বাপের বাড়ি এলাকায় হাতির শুঁড়ের আঘাতে প্রাণ হারায় ৭ মাসের শিশু মো. আরমান জাওয়াদ। হাতির আক্রমণে শিশুটির মা খজিমা বেগম (৩৭) গুরুতর আহত হাসপাতালের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

এদিকে গত এক বছরে শুধু হাতির বিরুদ্ধে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী থানায় শতাধিক অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছে আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনির হোসেন ও কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শরীফ।

বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে হাতির আক্রমণে মৃত্যু হয় মো. দুলাল (৫০) ও রেহেনা আক্তারের (৩৫)। ১২ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের দৌলতপুর এলাকার মোহাম্মদ ছৈয়দ (৫৭) ও গত ২৫ জানুয়ারি আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের মোহাম্মদ বদরুদ্দীন (২৯) নিহত হন। ২০২৩ সালের ৫ জুলাই আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের হাজীগাঁও এলাকার ছাবের আহমদ (৭৫) নিহত হন। ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আনোয়ারা উপজেলার বটতলী এলাকার আজিজ ফকিরের (৭০) মৃত্যু হয়। ১০ অক্টোবর গুয়াপঞ্চক এলাকায় হাতির আক্রমণে প্রাণ হারান মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি (৬০) ও কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের খিলপাড়া গ্রামের জালাল আহমদ (৭২)। ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের নুর পাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোলায়মান (৭০), ২ ফেব্রুয়ারি উত্তর গুয়াপঞ্চক এলাকার দেবী রানী দে (৪৫), ২০ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী উপজেলার দক্ষিণ শাহমীরপুর গ্রামের বড়ুয়াপাড়ায় মায়া রানী বড়ুয়া (৬০) ও ১৫ জুলাই আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের আখতার হোসেন চৌধুরীর (৫০) মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২৬ জুন রাতে আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম এলাকায় মৃত আবু তাহেরের স্ত্রী মোমেনা খাতুন (৬৫), ১৫ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের মৃত বদিউজ্জামান চৌধুরীর পুত্র আখতার হোসেন চৌধুরী (৫০), ১৮ আগস্ট বারখাইন ইউনিয়নের বটতলা এলাকার আবদুল মোতালেব (৬৮) মারা যান। ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের আবদুর রহমান (৭০) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে।

বন বিভাগ জানায়, ২০২০ সালের দিকে হাতির উৎপাত বন্ধে বন বিভাগ ৬০ জন প্রশিক্ষিত লোক নিয়ে ছয়টি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে। তাঁদের বাঁশি, মাইক ও পোশাক দেওয়া হয়। তবে এসব স্বেচ্ছাসেবক দলের কার্যক্রম পরে বন্ধ হয়ে যায়।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বন্য হাতি বংশ পরম্পরায় নির্দিষ্ট পথ ধরে হাঁটাচলা করে। এতে বিঘ্ন ঘটলে সে মারমুখী হয়ে ওঠে। গাছপালা বেশি না থাকলেও একসময় দেয়াঙ পাহাড়ে হাতি স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটাচলা করতে পারত। কিন্তু এখন তা পারছে না। এর ফলে নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া একটি হাতি দৈনিক ১৫-১৬ ঘণ্টা এবং ৭০-৮০ কিলোমিটার হাঁটে। খাবার খায় প্রায় ১৫০ কেজি। হাঁটাচলার পথ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি খাবারসংকটের কারণে হাতি লোকালয়ে প্রবেশ করছে।

হাতির আক্রমণে নিহতের পরিবারকে তিন লাখ টাকা ও আহতকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এর বাইরে খেত ফসলের ক্ষয়ক্ষতিরও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।

হাতির বিরুদ্ধে শতাধিক অভিযোগ:
হাতির বিরুদ্ধে আনোয়ারা–কর্ণফুলী থানায় একশতের বেশি জিডি ও অভিযোগ দায়ের করে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে হাতিগুলো সরানোর বিষয়ে বন বিভাগ উদাসীন।

ক্ষতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি:
হাতির তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতিও হলেও বন দফতরের উদাসীন। এই অভিযোগে সম্প্রতি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল আনোয়ারা প্রান্ত ও বড়উঠান সড়কে হাতি অপসারণের জন্য বিক্ষোভ-অবরোধ করেন এলাকাবাসী।

স্থানীয় বাসিন্দা মেজবাহ উদ্দিন খান বলেন, এখানে অবস্থান নেওয়া হাতিরা ভাবছে, এখনও এটিই তাদের আবাসস্থল। দিনের বেলা হাতি গুলো কেইপিজেডে অবস্থান আর লেকে ধারে ঘুরতে দেখা যায়। এসময়ই অনেক দশনার্থীকে তাদের বিরক্ত করতে দেখা যায়। যেটি কখনও কাম্য নয়। অনেক সময় হাতি নিজেদের রক্ষা করতেই মানুষের ওপর হামলা করে। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। আর বনের হাতি বনে ফিরিয়ে নিতে বনবিভাগসহ প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নোয়াব আলী বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া হাতির তাণ্ডবে আনোয়ারা-কর্ণফুলীবাসী অতিষ্ঠ। বিশেষ করে বৈরাগ, বড়উঠান ও বটতলী ইউনিয়নের লোকজন হাতির ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে।

হাতির সঙ্গে কেন মানুষের সংঘর্ষ বাধে:
হাতির বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণ পানি দরকার হয়। প্রতিদিন এদের ৮০ থেকে ১২০ লিটার পানি প্রয়োজন। বর্ষাকালে পাহাড়ে পর্যাপ্ত পানি এবং গাছপালা থাকার কারণে ওই সময় হাতি পাহাড়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

কিন্তু শীতকালে যখন বৃষ্টিপাত হয় না, পাহাড়ে জমে থাকা পানি শুকিয়ে যায়, তখন পানি পান করার জন্য হাতিরা নিচে, সমতল ভূমিতে চলে আসে। তখনই মানুষের সঙ্গে হাতিদের সংঘর্ষ বাধে। কারণ সমতলের মানুষ চাষাবাদ করেছে, ঘরবাড়ি করেছে—এবং সেটা করেছে হাতিদের চলাচলের রাস্তায় বা করিডোরে। হাতিরা বংশপরম্পরায় এসব করিডোর ব্যবহার করত। যখনই মানুষ এসব করিডোরে কোনো স্থাপনা বা চাষাবাদ করেছে, তখনই হাতিদের চলাচলের রাস্তা ও বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হয়েছে। এসব জায়গায় মানুষের চাষ করা সবজি, পাকা ধান কিংবা পাকা কাঁঠাল খেয়ে ফেলে হাতি। তখন এই প্রাণীটির সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষটা বাধে।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা:
জলদী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, দেয়াঙ পাহাড়ে চারটি হাতি অবস্থান নিয়েছে। এগুলো মাঝেমধ্যে লোকালয়ে নেমে আসে। লোকালয়ে কোনো ধরনের উত্ত্যক্তের শিকার হলে এসব হাতি জানমালের ক্ষতি করছে। তিনি আরও বলেন, হাতি জোর করে সরিয়ে নেওয়া যায় না, পাহারায় রাখতে হয়। লোকালয় থেকে ফিরে গেলে যাতে আর না আসে, সে চেষ্টা করা ছাড়া উপায় নেই।

হাতি গবেষকরা বলছেন, ‘পূর্ণবয়স্ক একটি হাতি দিনে ১৫০ থেকে ২০০ কেজি খাবার গ্রহণ করে। আমাদের পাহাড়গুলোতে এত খাবারের যোগান দেওয়ার সক্ষমতা আছে কি না সেটাও তো দেখতে হবে। হাতির আক্রমণে মৃত্যুর জন্য মানুষের অসচেতনতাই প্রধানত দায়ী। হাতি দেখলেই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে যায়। হাতির মুভমেন্ট যে স্বাভাবিক বিষয়, এটা মানুষ বুঝতে চায় না। হাতিকে বিভিন্নভাবে ডিস্টার্ব করে। একটি হাতি একবার হাঁটা শুরু করলে সে পথ দিয়ে বহুবার আসবে এটা তাদের অভ্যাস। বর্তমানে পথগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তারা যাবে কোথায়? পাহাড় ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা লোকালয়ে চলে আসে। হাতি পাহাড়ে খাবার পাচ্ছে না। এ সময়ে লোকালয়ে খাবার বেশি থাকে বলে ছুটে আসে তারা।’

হাতির সুরক্ষায় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন:
কোরিয়ান ইপিজেড এলাকার হাতির সুরক্ষায় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ইপিজেডের কর্মীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে করণীয় বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে।

সোমবার (২১ অক্টোবর) সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে কোরিয়ান ইপিজেড এর প্রেসিডেন্ট, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ কমিটি গঠন করা হয়।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে গঠিত এ বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান, আইইউসিএন এর প্রতিনিধি, কোরিয়ান ইপিজেড এর দুইজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন অভয়ারণ্যের রুবাইয়া আহমেদ এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা।

চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

没有找到评论