দিনাজপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নেতাকে অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারত এই ঘটনাকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক এবং পদ্ধতিগত নির্যাতনের একটি নতুন উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা ৫৮ বছর বয়সী শ্রী ভবেশ চন্দ্র রায় গত ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় নিজ বাসা থেকে অপহৃত হন। ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর, রাত ১০টার দিকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়, যা পরিবার, স্থানীয় জনগণ এবং রাজনৈতিক মহলে চরম ক্ষোভ ও আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিস্ফোরক বিবৃতি দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ পোস্ট করা বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমরা শ্রী ভবেশ চন্দ্র রায়ের অপহরণ এবং নির্মম হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে মর্মাহত। এটি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত নিপীড়নেরই একটি নিদর্শন।”
তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনার দায়ীদের শাস্তি না হওয়াটাই একটি বিপজ্জনক বার্তা বহন করে। আগের অপরাধীরাও শাস্তি না পেয়ে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ প্রবণতা এখনই বন্ধ না হলে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।”
ভারতের কড়া বার্তা: বাংলাদেশ সরকার যেন দায় এড়াতে না পারে
রণধীর জয়সওয়াল সরাসরি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমরা আবারও অন্তর্বর্তী সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তারা যেন কোনো অজুহাত তৈরি না করে কিংবা কোনো ভেদাভেদ না করে—সব সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করে।” এই মন্তব্য ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে একটি কঠোর বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পূর্ব সতর্কবার্তাও দিয়েছিল মোদি সরকার
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কয়েক সপ্তাহ আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরাসরি সতর্ক করেছিলেন। মোদি সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ওইবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ওয়াকফ বোর্ড ইস্যুতে কূটনৈতিক উত্তেজনা দেখা দেয়।
কিন্তু সেই উত্তেজনার মাঝেই ভবেশ রায়ের হত্যাকাণ্ড নতুন করে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে কঠিন অবস্থানে নিয়ে গেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
ভবেশ রায়ের পরিচয় ও সমাজে প্রভাব
শ্রী ভবেশ চন্দ্র রায় স্থানীয় হিন্দু সমাজের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন, যা তাঁকে শুধু বিরল উপজেলায় নয়, গোটা দিনাজপুর জেলায় একটি পরিচিত মুখে পরিণত করেছিল। তাঁর মৃত্যুতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ, আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও তদন্তের দাবি
এই ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তির দাবি উঠেছে। অনেকেই এই ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিচ্ছেন এবং প্রশ্ন তুলছেন, কেন এখনো এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের মূল পরিকল্পনাকারীদের ধরা হচ্ছে না।
দিনাজপুর জেলা পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে স্থানীয়রা দ্রুত দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছেন।
এই ঘটনা শুধু একটি হত্যা নয়—এটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গম্ভীর বার্তা বহন করে। ভারতের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবেশ রায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ—কীভাবে দ্রুত এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করে দেশ-বিদেশে আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়।