জাহিদ হাসান:
এক সময় দেশের কোরবানির পশুর চাহিদা মেটাতে প্রতিবেশী দেশ থেকে গরু আমদানি করতে হতো। সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। প্রাণিসম্পদ খাতে সরকারের ধারাবাহিক ও বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের ফলে আজ দেশেই উৎপাদিত গবাদিপশু দিয়ে কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। বরং প্রতিবছর ঈদের মৌসুম শেষে প্রায় ২০ লাখ গরু ও মহিষ উদ্বৃত্ত থাকছে।
পটভূমি ও উত্তরণের ধাপ
দশক খানেক আগেও খামারিদের বড় একটি অংশ নির্ভর করতেন স্বতঃস্ফূর্ত প্রশিক্ষণবিহীন পশু পালন পদ্ধতির ওপর। পশুখাদ্য, চিকিৎসা, টিকা এবং জাত উন্নয়নে তেমন সরকারি সহায়তা না থাকায় উৎপাদনে ছিল স্থবিরতা। গরু-ছাগলের খামার গড়ে তোলাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ২০১৫ সালের পর থেকে সরকার নানামুখী প্রকল্প হাতে নেয়। খামারিদের প্রশিক্ষণ, উন্নত জাতের পশু প্রজনন, ঘাস উৎপাদনে সহায়তা, টিকা ও ওষুধ বিতরণ এবং প্রযুক্তি সরবরাহকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত কর্মসূচি
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শনে গিয়ে খামারিদের সরাসরি পরামর্শ দিচ্ছেন। ঘাস উৎপাদনে ৮,৯৭০টি উন্নত প্রদর্শনী প্লট স্থাপন এবং ১৭,৯৪০টি খামারে আধুনিক ঘাস সংরক্ষণ প্রযুক্তি চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি ৮৯ হাজারের বেশি খামারিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে আধুনিক প্রাণিপুষ্টি বিষয়ে।
জেলে ও দরিদ্র পরিবারের কাছে বকনা বাছুর বিতরণ কর্মসূচিও চলমান রয়েছে। লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, ঝালকাঠি, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় লক্ষাধিক বকনা বাছুর বিতরণ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য প্রকল্প ও অর্থায়ন
এ পর্যন্ত ৮ থেকে ১০টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে:
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (৫,৩৮৯.৯২ কোটি টাকা), যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে প্রায় ২০% এবং ১ লাখ ৯১ হাজার খামারি উপকৃত হয়েছেন।
‘প্রভেন বুল’ তৈরির প্রকল্প (৬৭.৪৭ কোটি টাকা), যা ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলবে।
মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প (৭২.১১ কোটি টাকা)।
পিপিআর নির্মূল ও ক্ষুরারোগমুক্ত জোন গঠনের প্রকল্প, যেটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১৬.৫৪ কোটি টাকা এবং যার আওতায় মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ভোলা ও কুড়িগ্রাম জেলায় কার্যক্রম চলমান।
বর্তমান চিত্র ও পরিসংখ্যান
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা ৬৬ হাজার এবং অনিবন্ধিত ৭০ হাজার—সব মিলিয়ে মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার খামার। দুধ উৎপাদনে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে খামারের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এই খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন প্রায় ১ কোটি মানুষ।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
সরকার আশা করছে, চলমান প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশের দুধ উৎপাদনের ঘাটতি কমে আসবে এবং প্রাণিসম্পদ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আরও সুদৃঢ় হবে। সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, “উৎপাদন আরও বাড়াতে আমরা প্রতিদিন কাজ করছি। খামারিরা যাতে লাভবান হন, সেটিই আমাদের মূল লক্ষ্য।”