ড. ইউনূসের একটি মন্তব্য ঘিরেই কাঁপছে দিল্লি। মাথাব্যথার পরিণতি—২২ হাজার ৮৬৪ কোটি রুপির বিশাল মহাসড়ক প্রকল্প! উদ্দেশ্য একটাই: বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা কাটানো। কিন্তু আদৌ কি ভারত পারবে বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে সমুদ্রপথে যুক্ত হতে?
গত মার্চে চীন সফরকালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি মন্তব্য করেন, যা ভারতের ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনায় বড়সড় নাড়া দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো—যা ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত—তারা মূলত স্থলবেষ্টিত এবং সমুদ্রপথে তাদের একমাত্র অভিভাবক দেশ হলো বাংলাদেশ। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশকে চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলেও উল্লেখ করেন।
ড. ইউনূসের এই মন্তব্য ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে গভীর আলোচনার জন্ম দেয়। ‘আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সংযোগে’ বাংলাদেশের ভূমিকাকে পরোক্ষ হুমকি মনে করে তৎপর হয়ে ওঠে নয়াদিল্লি। লক্ষ্য একটাই: এমন একটি বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের জাতীয় মহাসড়ক এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করপোরেশন লিমিটেড (NHIDCL) একটি বিশাল পরিকল্পনা হাতে নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিলং (মেঘালয়) থেকে শিলচর (আসাম) পর্যন্ত চার লেন বিশিষ্ট দ্রুতগতির একটি নতুন মহাসড়ক নির্মাণ করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ১৬৬.৮ কিলোমিটার।
এই মহাসড়ক হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে, যার মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগ বাড়বে—বাংলাদেশের সাহায্য ছাড়াই।
ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, এই পরিকল্পনার পেছনে মূল প্রেরণা ড. ইউনূসের মন্তব্য। NHIDCL-এর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছি। আমরা চাই না যে আমাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকুক।”
তবে নতুন রাস্তাটি বাংলাদেশের বিকল্প হলেও, এবার নতুন নির্ভরতা গড়ে উঠবে মিয়ানমারের ওপর। কারণ, শিলং-শিলচর এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ভারতের বহুল আলোচিত কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট প্রজেক্ট।
এই প্রকল্পে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। এর মাধ্যমে কলকাতার সমুদ্রবন্দর যুক্ত হবে মিয়ানমারের সিত্তে নদী বন্দরের সঙ্গে। সেখান থেকে মিয়ানমারের পালেতওয়া এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের মিজোরামে পৌঁছাবে সড়কপথে। পরিকল্পনাটি এতটাই জটিল যে, একাধিক নদীপথ, সড়কপথ এবং পাহাড়ি অঞ্চল পার হতে হবে—যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নতুন মহাসড়ক ও কালাদান প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বহু বাধা রয়েছে। বিশেষ করে মেঘালয় ও আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে মহাসড়ক নির্মাণ মানেই ভূমিধস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা। তার পরও, ভারত এত বড় বিনিয়োগে এগিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র বাংলাদেশ নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গত ৩০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এই ২২ হাজার ৮৬৪ কোটি রুপির প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। ভারত আশা করছে, এই সময়ের মধ্যে শিলং-শিলচর এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হবে এবং সমান্তরালভাবে কালাদান প্রকল্পও সম্পন্ন হবে।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এত বিশাল ব্যয়ে বিকল্প পথ তৈরি করেও ভারত পুরোপুরি বাংলাদেশকে পাশ কাটাতে পারবে না। কারণ, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন একটি কৌশলগত জায়গায় যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের জন্য সেটি অগ্রাহ্য করা কঠিন।
ড. ইউনূসের একটি মন্তব্য কেবল কাগজে লেখা কথায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেটি আঘাত করেছে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনায়, কাঁপিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ভারসাম্য।
এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার-ভারত এই চার দেশের মধ্যে নতুন কী ধরনের প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার সূত্রপাত ঘটে এই মহাসড়ক এবং ভূরাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে দিয়ে।