close
ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!
চমকপ্রদ শ্বেতপত্রের পেছনে দুর্নীতির ‘ধামাচাপা’! এনসিটিবির প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ, কোথায় গেল শিক্ষা


দেশের শিক্ষা খাতে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র অজানা রয়ে গেছে—এমনই অভিযোগ উঠেছে এনসিটিবির (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) শ্বেতপত্র নিয়ে। শ্বেতপত্রে প্রায় সব দুর্নীতির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগে ক্ষুব্ধ শিক্ষা গবেষকরা। তাতে দেখা গেছে, বই ছাপানো, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় হওয়া কোটি কোটি টাকা সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট তথ্য নেই। বিশেষ করে, শিক্ষা খাতে অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, শ্বেতপত্রে সেগুলির কোন উল্লেখ নেই।
এনসিটিবির গঠিত কমিটি: শ্বেতপত্রে ‘ধোঁয়াশা’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশে ২৪ অক্টোবর এনসিটিবি একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল দেশের শিক্ষা খাতে দুর্নীতি অনুসন্ধান করা এবং সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে যে, কমিটির অধিকাংশ সদস্যই পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। শ্বেতপত্রে এমন কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা শিক্ষাখাতে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার সাথে যুক্ত ছিলেন।
কমিটিতে আছেন এনসিটিবির প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম, উৎপাদন নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু নাসের টুকু, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ মো. আব্দুল মুমিন মোছাব্বির এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের সকলেরই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে, এনসিটিবির সচিব ফিরোজ আল ফেরদৌসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিতর্কও রয়েছে, যিনি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ভাগ্নে পরিচয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করেছেন।
এনসিটিবির শ্বেতপত্রের তথ্য গোপন: কোটি টাকার অপব্যবহার!
শ্বেতপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-২০২৩ সালের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ সংক্রান্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে যে, বই ছাপানোর খরচে প্রতি বছর অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সেগুলোর কোনও উল্লেখ নেই। বিশেষ করে, বিভিন্ন কর্মশালায় কীভাবে লাখ লাখ টাকা অপচয় হয়েছে এবং কিভাবে পাঁচ তারকা হোটেলে প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছে, তা গোপন রাখা হয়েছে।
এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ১২শ কোটি টাকা খরচের তথ্য অপ্রকাশিত রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ব্যয় হয়েছে। যদিও শ্বেতপত্রে প্রাথমিক শ্রেণির প্রশিক্ষণ খাতে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকার খরচ দেখানো হয়েছে, তবে অন্য প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থের তথ্য গোপন রাখা হয়েছে।
এনসিটিবির দুর্নীতির ‘অন্ধকারে’ রয়ে গেল হাজার কোটি টাকার হিসাব
এনসিটিবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের কমিটি প্রাথমিক সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে, তবে এই তথ্য আরও বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু কমিটি ও এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের দাবি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এটি সম্ভব হয়নি। শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, এই রিপোর্টের মাধ্যমে বাস্তবিকভাবে দুর্নীতির চিত্র আনা সম্ভব হয়নি, কারণ যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তারা এখনো এনসিটিবির গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন।
শিক্ষা গবেষকরা অভিযোগ করেন, এনসিটিবির শ্বেতপত্রে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র গোপন রাখা হয়েছে, যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব এবং এক ধরনের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করেন, যদি শিক্ষা খাতে স্বচ্ছতা আনার জন্য সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তবে অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
এদিকে, শ্বেতপত্রে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যেমন ‘নাশতা ভাতা’ ও ‘অপচয়ী খরচ’ সংক্রান্ত অবৈধ তহবিল সংগ্রহ। ২ লাখ টাকার নাশতা ভাতা ও একাধিক কর্মশালার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, যা অডিটেও ত্রুটি হিসেবে উঠে এসেছে। তবে, এনসিটিবি চেয়ারম্যান এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন এবং দাবি করেছেন যে এসব খরচ কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: এনসিটিবির শ্বেতপত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের চিহ্ন
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও অন্যান্য কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, শ্বেতপত্রের প্রতিবেদন তৈরিতে রাজনৈতিক কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, শ্বেতপত্রে যে ধরনের তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের একটি স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্নীতি লুকানোর একটি পদক্ষেপ হতে পারে।
এনসিটিবির কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এবং শ্বেতপত্রের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র আনার বদলে অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে।
এনসিটিবির শ্বেতপত্রের চূড়ান্ত প্রতিবেদন যদি এসব অভিযোগের উত্তর না দেয়, তবে দেশের শিক্ষা খাতে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র সামনে আসা আর কঠিন হবে।
No comments found