শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মুলনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ. জলিল মাদবরকে একটি চেক জালিয়াতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেই সূত্রে তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন। কিন্তু বরখাস্তের আদেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি যেন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই এখনো পরিষদে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন, দিচ্ছেন স্বাক্ষর, নিচ্ছেন সিদ্ধান্ত—সবকিছুই যেন এক অঘোষিত ‘চেয়ারম্যানশিপ’ চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে আ. জলিল মাদবর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার বিরুদ্ধে থাকা ব্যবসা সংক্রান্ত একটি চেক জালিয়াতির মামলায় ২০২৩ সালের ১৯ মে শরীয়তপুরের যুগ্ম দায়রা জজ প্রথম আদালত তাকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ সাতাশি হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। রায়ের পরপরই তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কিছুদিন জেলেও ছিলেন।
এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিষয়টি জেলা প্রশাসকের কাছে জানালে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ তাকে ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯-এর ৩৪(৪)(শ)(ঘ) ধারায় সাময়িক বরখাস্ত করে। এ আদেশে বলা হয়, কেন তাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হবে না—সে বিষয়ে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শাতে হবে।
এখানেই প্রশ্নের শুরু। ইউপি সচিব লিপি আক্তার জানিয়েছেন, বরখাস্তের কোনো আদেশ প্রত্যাহার হয়েছে কি না, সে সংক্রান্ত অফিসিয়াল কোনো কাগজ তারা পাননি। পরিষদের অন্য কোনো সদস্য বা কর্মকর্তা কেউই এমন কোনো নির্দেশনা দেখেননি।
তবুও আ. জলিল মাদবর নিয়মিত পরিষদে আসছেন, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে স্বাক্ষর করছেন, নাগরিক সনদ পর্যন্ত দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সচিব সরাসরি জানান, “আমরা তাকে বাধা দেওয়ার সাহস পাই না।” ইউএনওর অফিসেও বরখাস্ত প্রত্যাহারের কোনো আদেশ পাওয়া যায়নি।
চেয়ারম্যান আ. জলিল মাদবর অবশ্য দাবি করছেন, “বিষয়টি একটি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল। মামলায় দণ্ডিত হই ঠিকই, কিন্তু পরে উচ্চ আদালতের আদেশে আবার দায়িত্বে ফিরে এসেছি।” তবে তিনি কোনো লিখিত প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি কোন আদালতের আদেশে দায়িত্ব পালন করছেন সেটিও স্পষ্টভাবে বলতে পারেননি।
জাজিরা উপজেলার ইউএনও কাবেরী রায় এ বিষয়ে বলেন, “আমাদের কাছে কোনো পুনর্বহালের আদেশ নেই। পরিষদে একজন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আছেন, প্রকল্পের বরাদ্দও তার নামে দেওয়া হয়। যদি বরখাস্ত হওয়া ব্যক্তি প্রতারণার আশ্রয়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হচ্ছে—প্রশাসনের লিখিত আদেশ, আদালতের রায় ও নিয়মকানুন উপেক্ষা করে কীভাবে একজন ব্যক্তি ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন। এটা শুধু আইনের চোখে অপরাধ নয়, স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকারিতা ও জনসেবার স্বচ্ছতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বরখাস্ত হওয়া কোনো ব্যক্তি যদি প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে জনসেবার নামে ক্ষমতা ব্যবহার করেন, তাহলে এটি স্থানীয় সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করে।
এই ঘটনার তদন্ত, যথাযথ প্রমাণ যাচাই ও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ ছাড়া এমন নজির স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে না। একজন দণ্ডিত ও বরখাস্তপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি নির্বিঘ্নে সরকারি কাগজে স্বাক্ষর করতে পারেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবে—আমাদের আইন আসলে কার জন্য? প্রশাসনের ঘুম ভাঙবে কবে?