চানখারপুল গণহত্যা: সাবেক ডিএমপি কমিশনারসহ ৮ পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ, জমা পড়লো ৯০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন
রাজধানীর পুরান ঢাকার চানখারপুলে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনায় প্রথমবারের মতো দায়ী করা হলো পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের। ঘটনার প্রায় ৭ মাস পর তদন্ত শেষে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ মোট ৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
গত ৫ আগস্ট, চানখারপুল এলাকায় ঘটে এই রক্তাক্ত ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিন পুলিশের গুলিতে অন্তত ৬ জন নিহত হন। আর এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে শুধু মাঠপর্যায়ের নয়, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল—তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
এই তদন্ত কাজটি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে ১৯৫ দিন। তদন্ত সংস্থা ৯০ পৃষ্ঠার একটি বিশ্লেষণধর্মী ও তথ্যবহুল প্রতিবেদন তৈরি করে। সেটি গত ২০ এপ্রিল, রোববার প্রসিকিউশন টিমের কাছে জমা দেওয়া হয়।
এরপরদিন, ২১ এপ্রিল (সোমবার) বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি জানান, “চানখারপুলের গণহত্যা মামলার তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এটি জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার মধ্যে প্রথম তদন্ত সমাপ্ত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।”
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ:
তদন্ত প্রতিবেদনে নাম উঠে এসেছে মোট ৮ জন পুলিশের। তারা হলেন:
-
হাবিবুর রহমান – সাবেক কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)
-
সুদীপ কুমার চক্রবর্তী – সাবেক যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি
-
শাহ আলম – সাবেক এডিসি, রমনা জোন
-
মো. ইমরুল রমজান – সাবেক এসি, ডিএমপি
-
আরশাদ হোসেন – সাবেক পুলিশ পরিদর্শক, অপারেশন শাখা, শাহবাগ থানা
-
সুজন – কনস্টেবল
-
ইমাদ হোসেন – কনস্টেবল
-
নাসিরুল ইসলাম – কনস্টেবল
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপরের তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাদের কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি ছিল। যারা সরাসরি গুলি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহ করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক আইজিপি-এর সংশ্লিষ্টতা বিষয়েও কিছু তথ্য উঠে এসেছে। তদন্তে এদের ভূমিকা ও জ্ঞাতসারে সংঘটিত ঘটনার প্রাথমিক আলামত ধরা পড়েছে।
পলাতক আসামিরাও রয়েছে তালিকায়
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, মামলার চারজন আসামি পলাতক রয়েছে। তারা বিদেশে আত্মগোপন করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
তদন্তে কী উঠে এলো?
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি ছিল পরিকল্পিত। গুলিবর্ষণ, তাণ্ডব ও সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচারে হামলার দায় শুধু মাঠপর্যায়ের সদস্যদের নয়, বরং তা পরিকল্পিতভাবে উর্ধ্বতন মহল থেকে পরিচালিত হয়েছিল।
বিশেষ করে, ভিডিও ফুটেজে কয়েকজন অফিসারের গুলির নির্দেশনা ও উপস্থিতি ধরা পড়ে। একজন এডিসি ও এক সাবেক কমিশনারের গোপন ফোনালাপ এবং ঘটনাস্থলে মোবাইল টাওয়ার লগ বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করা হয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
প্রসিকিউশন এখন এই প্রতিবেদন যাচাই করে চার্জ গঠন এবং মামলাটিকে বিচারযোগ্য করার জন্য আদালতে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক শুনানির পর এই মামলার বিচার শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, “এটি শুধু চানখারপুল গণহত্যার বিচারই নয়, বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভেতরে থেকে যারা জনগণের নিরাপত্তার বদলে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে—তাদের জবাবদিহিতার প্রথম পদক্ষেপ।