উৎসবে উচ্ছ্বাসে নববর্ষের অভ্যর্থনা: ঢাবিতে বর্ণাঢ্য বর্ষবরণ শোভাযাত্রা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরচেনা চারুকলা অনুষদ সকালটা আজ যেন অন্য রকম এক চেহারা ধারণ করেছিল। রঙ, শিল্প, ঐতিহ্য আর প্রাণের মেলবন্ধনে শুরু হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর সবচেয়ে প্রতীক্ষিত আয়োজন—বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।
আজ সোমবার, ১৪ এপ্রিল সকাল ৯টা। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণ থেকে বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। চারদিকে হাজারো মানুষের পদচারণা, মুখরিত আকাশ, আর বাহারি মুখোশ ও কাঠামোর ছড়াছড়ি—সব মিলিয়ে যেন পুরো ঢাকা শহর রঙে রঙে ঢেকে গেছে।
🌈 শোভাযাত্রার রুট, রঙ ও রূপ
চারুকলা অনুষদ থেকে যাত্রা শুরু করে শোভাযাত্রাটি ঘুরে এসেছে শাহবাগ, টিএসসি, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি হয়ে আবার চারুকলা প্রাঙ্গণে ফিরে যায়। পুরো রুটজুড়েই ছিল জমজমাট মানুষের ভিড় ও উদ্দীপনা। এ যেন ছিল এক ‘ভ্রাম্যমাণ শিল্প মেলা’।
এবারের শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ছিল—‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। প্রতিটি ধাপে ফুটে উঠেছে সেই বার্তাই। লোকজ শিল্পের নানান অনুষঙ্গে সাজানো ছিল পুরো মিছিল। বিশাল আকৃতির কাঠামো, রঙিন মুখোশ, নানা রকম প্রতিকৃতি—সব কিছুতেই যেন কথা বলেছে বাঙালির সংস্কৃতি ও প্রতিবাদের সৌন্দর্য।
বিশেষভাবে নজর কেড়েছে—ইলিশ মাছ, বাঘ, ঘোড়া, হাতি, তরমুজ ও পরিবেশ সচেতনতামূলক ‘পানি লাগবে পানি’ কাঠামো। এসব প্রতিকৃতির মাধ্যমে যেমন প্রকাশ পেয়েছে লোকজ সংস্কৃতি, তেমনি এসেছে পরিবেশ ও রাজনীতির ইঙ্গিতও।
🧍♂️👨👩👧👦 জনতার ঢল, পরিবারে-বন্ধুতে সাজানো প্রহর
শুধু ছাত্র বা শিল্পী নয়, উৎসবে ভিড় জমিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধু বা প্রিয়জনদের সঙ্গে। শিশুদের হাতে ছোট ছোট মুখোশ, কারো গালে আঁকা রঙ, আবার কারো হাতে ধরা ফুল—সব কিছু মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক বৈচিত্র্যময় দৃশ্যপট।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত অনেকেই। কেউ দাঁড়িয়ে মিছিল দেখছেন, কেউ বা নিজেরাও ধীরে ধীরে ভিড়ে মিশে যাচ্ছেন। প্রিয়জনের সঙ্গে সেই মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দি করতে যেন একে অপরের প্রতিযোগিতা।
👮 নিরাপত্তায় কঠোর নজরদারি
এত বড় আয়োজন নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ছিল বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শোভাযাত্রার পুরো রুটজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং বিশেষ পর্যবেক্ষণ দল।
চারুকলা চত্বর ও তার আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছে র্যাব, ডিবি ও পুলিশের টহল দল। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা যেন না ঘটে, সেদিকে বিশেষ নজর ছিল প্রশাসনের।
🥁 শিল্প, প্রতিবাদ আর প্রাণের মিলনমেলা
বর্ষবরণের এই শোভাযাত্রা শুধু উৎসব নয়, এটি এক প্রতিবাদের ভাষা, এক সাংস্কৃতিক বার্তা। ‘ফ্যাসিবাদের অবসান’-এর মতো শক্তিশালী স্লোগানে স্পষ্ট হয়েছে মানুষের মনের কথা। শিল্প যে কেবল রঙ আর কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—তাও প্রমাণিত হলো আজকের আয়োজনে।
লোকজ ঐতিহ্যের এমন সমারোহ নতুন প্রজন্মের মনে সৃষ্টি করেছে বাঙালিয়ানার প্রতি নতুন ভালোবাসা। যারা একবার এসেছেন, তারা বলছেন—এই আয়োজন না দেখলে বাংলা নববর্ষ পূর্ণ হয় না।
📍 উপসংহার:
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে বরণ করতে ঢাবি ক্যাম্পাস যেন আজ একটুখানি বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে। হাজারো মানুষের প্রাণের ছোঁয়ায়, শিল্পের সৌন্দর্যে এবং প্রতিবাদের বার্তায় সমৃদ্ধ এই শোভাযাত্রা আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে—বর্ষবরণ মানে শুধু উৎসব নয়, এটা বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রকাশ।