বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনে শুরু হয়েছে চার দিনব্যাপী 'দ্য বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলন-২০২৫'। দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলে অবস্থিত হাইনান প্রদেশের পর্যটন শহর বোয়াওতে মঙ্গলবার শুরু হওয়া এই সম্মেলন শেষ হবে আগামীকাল শুক্রবার।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সরকারের পাঠানো বিশেষ ফ্লাইটে বুধবার দুপুরে ঢাকা ছেড়েছেন। আজ সন্ধ্যায় তিনি হাইনান প্রদেশের কিয়োংহাই শহরে পৌঁছাবেন এবং আগামীকাল বৃহস্পতিবার সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন।
শুক্রবার বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও, তিনি দেশটির মর্যাদাপূর্ণ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেবেন, যেখানে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হবে। তার সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরা।
সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু
এবারের বোয়াও ফোরামের মূল প্রতিপাদ্য 'বিশ্ব পরিবর্তনের মধ্যে এশিয়ার ভবিষ্যৎ গঠন'। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চল থেকে প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। চারটি মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে—
আস্থা পুনর্গঠন ও সহযোগিতা বৃদ্ধি
বিশ্বায়নের পুনঃসামঞ্জস্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন
টেকসই উন্নয়ন
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উদ্ভাবনী উন্নয়ন
তবে, এবারের সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এজন্য দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আলোচনা উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিনিয়োগের দিগন্ত উন্মোচন
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বক্তব্যে বাংলাদেশের নির্মাণ, সেবাখাত ও জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তুলে ধরবেন। জানা গেছে, তিনি বোয়াও ফোরামে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানাবেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে গড়ে তুলতে নানা সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। সফরের সময় ড. ইউনূস চীনের ২০০-এর বেশি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালুর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা সহজেই প্রয়োজনীয় সকল সুবিধা পেতে পারেন।
নতুন কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে অর্থনৈতিক, সামরিকসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে ভারতনির্ভরতা ছিল। তবে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এই প্রেক্ষাপটে চীন সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার চীনের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতেও আলোচনা করবে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের অংশ।
গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক মাইলফলক
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতনের পর এটি বাংলাদেশের প্রথম উচ্চপর্যায়ের চীন সফর। এ কারণে এটি আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান উপদেষ্টার এই সফর শুধু বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককেই শক্তিশালী করবে না, বরং এশিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
শেষ কথা
বোয়াও ফোরামে বাংলাদেশের ভূমিকা এবং ড. ইউনূসের সফর নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। তার বক্তব্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
এই সফর কেবল অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।



















