ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল)—এক সময়ের সম্ভাবনাময় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এখন দুর্নীতি ও অনিয়মের গহ্বরে নিমজ্জিত। পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের হাতে লুটের পর ২০২০ সালে আদালতের নির্দেশে গঠিত হয় নতুন পরিচালনা পর্ষদ। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে পুনরুদ্ধার করা। তবে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও উন্নয়নের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। বরং অনিয়ম-দুর্নীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।
বর্তমান চেয়ারম্যান মাসে ৩ লাখ টাকা বেতন নিয়ে নিজ এনজিও ‘উদ্দীপন’-এর মাধ্যমে আইএলএফএসএলের বন্ধকি সম্পদ কম দামে কিনে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে দেন বিপুল অঙ্কের সুদ মওকুফ, দুর্বল প্রতিষ্ঠানে ঋণ প্রদান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের হুমকি দেওয়ার মতো কার্যকলাপ। ফলে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদালত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবেদনের ভিত্তিতে পর্ষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের হার ৯৪%, যা এ খাতের জন্য বিপজ্জনক মাত্রা। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সূচকও ভয়াবহভাবে নেতিবাচক—সিআরআর রেশিও ১১২.০৮% ঋণাত্মক, আর প্রভিশন ঘাটতি ১৬৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত কুমির খামার ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’ খেলাপি থাকা সত্ত্বেও ৯১ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ বাদ রেখে আরও ৩.৩১ কোটি টাকা ঋণ দেয় আইএলএফএসএল। পরে সেই খামার মাত্র ৩৮.২০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়, এবং তা কিনে নেয় চেয়ারম্যানের নিজের এনজিও উদ্দীপন।
তদন্তে আরও উঠে আসে, বিক্রির সময় খামারে ২ হাজার কুমির আছে বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৩,৭১৪টি। লুকানো হয় ১,৭১৪টি কুমিরের তথ্য, যাদের বাজার মূল্য ছিল ৩১ কোটি টাকারও বেশি। খামারে সংরক্ষিত ১৪ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতও যায় উদ্দীপনের দখলে। অর্থাৎ, মাত্র ৩৮ কোটি টাকায় ৪৫ কোটির সম্পদ হস্তান্তর!
এখানেই শেষ নয়। এ অ্যান্ড পি ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যার চেয়ারম্যান এক সাবেক সচিব, তাকে ১০৫.৮৫ কোটি টাকার স্থিতি থেকে ৪০ কোটি টাকা মওকুফ করে ঋণ পুনঃতপশিল করা হয়, যা স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘন।
আরো উঠে এসেছে বিপুল ঋণ বিতরণের তথ্য—মুন্নু সিরামিক, আরামিট লিমিটেড, এলিট পেইন্ট, সুপার সিলিকা বাংলাদেশ লিমিটেড, এবং তাহের রাহুল নামের একজন ব্যক্তিকে ঘিরে বিতরণকৃত অনিয়মিত ঋণগুলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যথাযথ জামানত না রেখে এবং আর্থিক সূচকের দুরবস্থার মধ্যেও এগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আদালতের অধীনে পরিচালিত হওয়ার কারণে তারা সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। তবে অনিয়মগুলো আদালতকে জানানো হয়েছে। নতুন পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি সংস্কারের পথে যাচ্ছে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন বোর্ডে আসছেন বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। সাবেক ডেপুটি অডিটর জেনারেল মাহবুবুল হক হচ্ছেন নতুন চেয়ারম্যান। সদস্য হিসেবে থাকছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল মান্নান, শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এসইভিপি আশরাফুজ্জামান, এবং আরও কয়েকজন অভিজ্ঞ পেশাজীবী। নতুন বোর্ড সদস্যরা পাবেন সুনির্ধারিত সম্মানী—চেয়ারম্যান মাসে দেড় লাখ টাকা, বাকিরা প্রতিটি বৈঠকে ১০ হাজার টাকা, সর্বোচ্চ তিনটি বৈঠক পর্যন্ত।
অর্থাৎ, দুর্নীতির ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে এখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে। তবে কতটা সফল হবে এই নতুন বোর্ড, তা সময়ই বলে দেবে।