close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

বিদ্যুতের আবিষ্কার এবং টেসলা-এডিশনের সেই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব: যেভাবে নির্ধারিত হয়েছিল আজকের বিশ্ব..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত আজকের এই বিশ্ব একদিন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—ডিসি এবং এসি কারেন্টের দ্বন্দ্বে। টমাস এডিসনের একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে নিকোলা টেসলার যুগান্তকারী উদ্ভাবন কীভাবে এক অসম অর্থনৈতিক লড়াইয়ে..

আজকের আধুনিক বিশ্ব বিদ্যুৎ ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও কল্পনা করা যায় না। কিন্তু এই বিদ্যুৎকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ এবং রোমাঞ্চকর ইতিহাস, যা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তীব্র অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, ব্যবসায়িক ষড়যন্ত্র এবং দুজন মহান বিজ্ঞানীর মধ্যকার এক ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বটি ছিল ডাইরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) এবং অল্টারনেটিং কারেন্ট (এসি)-এর মধ্যে, যার একদিকে ছিলেন কিংবদন্তী উদ্ভাবক ও shrewd ব্যবসায়ী টমাস এডিসন এবং অন্যদিকে ছিলেন স্বপ্নদর্শী বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা। তাদের এই লড়াই, যা ইতিহাসে ‘কারেন্টের যুদ্ধ’ বা ‘War of the Currents’ নামে পরিচিত, শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত বিতর্ক ছিল না, এটি ছিল ভবিষ্যৎ পৃথিবীর শক্তি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের এক অসম অর্থনৈতিক লড়াই।

বিদ্যুতের ধারণাটি প্রায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক থেলিসের হাত ধরে শুরু হলেও, এর বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয় অনেক পরে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ঘুড়ি ওড়ানো পরীক্ষা, আলেসান্দ্রো ভোল্টার প্রথম ব্যাটারি আবিষ্কার এবং মাইকেল ফ্যারাডের তড়িৎচুম্বকীয় আবেশের সূত্র—এই সবকিছুর ওপর ভিত্তি করেই বিদ্যুৎ তার আধুনিক রূপ পায়। তবে, বিদ্যুৎকে সাধারণ মানুষের ঘরে আলো জ্বালানোর কাজে প্রথম সফলভাবে ব্যবহার করেন টমাস এডিসন। ১৮৮২ সালে তিনি নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং তার উদ্ভাবিত দীর্ঘস্থায়ী কার্বন ফিলামেন্টের বাল্বের মাধ্যমে ঘরবাড়ি ও কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেন।

টমাস এডিসন যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাটি তৈরি করেছিলেন, তা ছিল ডাইরেক্ট কারেন্ট বা ডিসি। কিন্তু এই ডিসি ব্যবস্থার একটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল—এটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মাত্র দেড় মাইলের বেশি দূরে সরবরাহ করা যেত না। এর ফলে, প্রতি দেড় মাইল পরপর একটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে হতো, যা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই সুযোগে, এডিসন তার বিদ্যুৎ সেবার জন্য সাধারণ বাড়িঘরের তুলনায় কলকারখানা থেকে তিনগুণ বেশি মূল্য আদায় করতেন, যা তার একচেটিয়া ব্যবসার একটি মডেল ছিল।

ঠিক এই সময়েই দৃশ্যপটে আসেন নিকোলা টেসলা, একজন সার্বিয়ান-আমেরিকান মেধাবী প্রকৌশলী, যিনি একসময় এডিসনের প্রতিষ্ঠানেই কাজ করতেন। টেসলা ডিসি ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে পারেন এবং এর বিকল্প হিসেবে অল্টারনেটিং কারেন্ট বা এসি ব্যবস্থার একটি যুগান্তকারী ধারণা দেন। এসি ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করে এর ভোল্টেজকে খুব সহজেই কমানো বা বাড়ানো যায়, যার ফলে এটি খুব কম খরচে শত শত মাইল দূরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। টেসলা তার এই ধারণাটি এডিসনের কাছে উপস্থাপন করলে, এডিসন সেটিকে ‘ বিপজ্জনক’ এবং ‘অবাস্তব’ বলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন।

পরবর্তীতে টেসলা আমেরিকান উদ্যোক্তা জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের সঙ্গে হাত মেলান, যিনি এসি ব্যবস্থার বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ওয়েস্টিংহাউস টেসলার এসি প্রযুক্তির পেটেন্ট কিনে নেন এবং এডিসনের ডিসি ব্যবস্থার চেয়ে প্রায় তিনগুণ কম মূল্যে এবং বাড়িঘর ও কারখানার জন্য একই দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেন। এই সাশ্রয়ী এবং কার্যকর এসি ব্যবস্থা খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে, যা টমাস এডিসনের একচেটিয়া ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

নিজের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে টমাস এডিসন এক নজিরবিহীন অপপ্রচারের আশ্রয় নেন। তিনি এসি কারেন্টকে ‘মৃত্যুর কারেন্ট’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রকাশ্যে কুকুর, বিড়াল এবং এমনকি একটি সার্কাসের হাতিকে এসি কারেন্ট দিয়ে হত্যা করে এর ভয়াবহতা দেখানোর চেষ্টা করেন, যা ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কিন্তু তার এই অপপ্রচার শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এসি ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে এটিই বিশ্বজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়। এই ব্যবসায়িক লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে এডিসনকে তার নিজের কোম্পানি থেকেই বরখাস্ত হতে হয়, যা পরবর্তীতে ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

আজ আমাদের घर থেকে শুরু করে কলকারখানা পর্যন্ত সর্বত্রই যে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তা মূলত নিকোলা টেসলার সেই এসি ব্যবস্থারই ফসল। টমাস এডিসন একজন महान উদ্ভাবক হলেও, তার ব্যবসায়িক একাধিপত্য এবং অনৈতিক প্রচারণা তাকে ইতিহাসের এক বিতর্কিত চরিত্রে পরিণত করেছে। অন্যদিকে, নিকোলা টেসলা তার স্বপ্ন এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত লড়াইয়েই জয়ী হননি, বরং তিনি সমগ্র মানবজাতিকে একটি সাশ্রয়ী এবং কার্যকর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছেন, যা আজকের আধুনিক বিশ্বকে সম্ভব করে তুলেছে। এই ‘কারেন্টের যুদ্ধ’ প্রমাণ করে, উদ্ভাবন এবং বাণিজ্যের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত সেই প্রযুক্তিই টিকে থাকে, যা মানবতার জন্য সবচেয়ে বেশি কল্যাণকর।

No comments found


News Card Generator