close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

ভারতে নিহত মাদরাসা শিক্ষককে যেভাবে ‘সন্ত্রাসী’ অপবাদ দেওয়া হয়..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
কাশ্মীর সীমান্তে গোলায় নিহত হলেন এক নিরীহ মাদরাসা শিক্ষক, কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া তার মৃত্যু নিয়ে ছড়াল ভুয়া বর্ণনা। মোহাম্মদ ইকবালের পরিবারের দাবি—তিনি ছিলেন শান্ত মানুষ, কিন্তু মিডিয়া বানিয়ে দিলো '..

কাশ্মীরের সীমান্তে সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যে নিহত হন মাদরাসা শিক্ষক মোহাম্মদ ইকবাল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশ তাকে 'সন্ত্রাসী' হিসেবে চিত্রিত করে, যা শুধুমাত্র একটি পরিবারের শোককে আরও বেদনার করে তোলে।

মোহাম্মদ ইকবাল ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার বাসিন্দা। দীর্ঘ দুই দশক ধরে তিনি স্থানীয় একটি মাদরাসা—‘জিয়া-উল-উলুম’-এ শিক্ষকতা করতেন। ৭ মে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সীমান্ত এলাকায় গুলিবর্ষণে নিহত হন তিনি। ভারত দাবি করে, তারা পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ২৬ জনের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়েছে। পরদিন গোলাবর্ষণে ইকবালের মৃত্যু হয়। পাকিস্তান এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক বিভ্রান্তি। ভারতীয় কিছু টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করে, ইকবাল ছিলেন সন্ত্রাসী এবং পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে লস্কর-ই-তৈয়বার ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলেন। তাদের রিপোর্টে ইকবালের ছবি ব্যবহার করে বলা হয়, ‘ভারতীয় বাহিনী এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে।’

এই প্রচারণার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইকবালের পরিবার। তার ভাই ফারুক আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ভাই কেবল একজন শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু শুধু দাড়ি আর টুপি দেখে মিডিয়া তাকে সন্ত্রাসী বানিয়ে দিল। ওর সম্মান কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”

ফারুক আরও বলেন, “আমরা যখন ভাইয়ের দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন হঠাৎ এক আত্মীয় হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভিডিও পাঠান। তাতে দেখা যায় একটি জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল বলছে—ইকবাল সন্ত্রাসী ছিলেন। এই ভুয়া খবর আমাদের মর্মাহত করে।”

এইসব প্রতিবাদের পর ৮ মে পুঞ্চ জেলার পুলিশ এক বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, মোহাম্মদ ইকবাল একজন সম্মানিত শিক্ষক, যার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। একইসাথে, যারা ভুয়া খবর ছড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।

তবে ইকবালের পরিবারের মতে, এই ব্যাখ্যা এসেছে অনেক দেরিতে। ততক্ষণে অসংখ্য মানুষ ওই বিভ্রান্তিকর খবর দেখে ফেলেছে, এবং অনেকেই হয়ত আজও বিশ্বাস করে ইকবাল ছিলেন সন্ত্রাসী। ফারুক বলেন, “নিউজ১৮ ছাড়া আর কোনো চ্যানেল এখনো আমাদের কাছে ক্ষমা চায়নি।”

শুধু মানহানিই নয়, ইকবালের পরিবারের সামনে এখন অর্থনৈতিক সংকটও ঘনিয়ে এসেছে। তিনি ছিলেন দুই স্ত্রীর ও আট সন্তানের একমাত্র উপার্জনকারী। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেলেও, তা দীর্ঘমেয়াদে টিকবে না বলে আশঙ্কা পরিবারের। ফারুক বলেন, “ভাই ছিল খুব শান্ত স্বভাবের। শিশুরা তাকে খুব পছন্দ করতো। এমন মানুষকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সমাজে কী বার্তা দেওয়া হলো?”

এই ঘটনায় উঠে এসেছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা কোথায়? ‘নিউজলন্ড্রি’ নামের একটি ভারতীয় সাংবাদিকতাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক মানীষা পাণ্ডে এই কভারেজকে অভূতপূর্ব বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “নাটকীয়তা আমরা আশা করি। কিন্তু এভাবে দায়িত্বহীন ও যুদ্ধোন্মাদ কভারেজ আগে কখনো দেখিনি।”

এই ঘটনাটি কেবল এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি হলো একটি পরিবারের সামাজিক ও মানসিক মৃত্যু, যা আরও তীব্র হয়ে ওঠে মিডিয়ার অসততা ও বেপরোয়া sensationalism-এর কারণে। এমনকি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো ভুয়া ভিডিও, করাচি বন্দরে ভারতের হামলার মিথ্যা খবর—এইসব তথ্য যেভাবে ছড়ানো হয়েছে, তা গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়—যারা মিথ্যা বলল, যারা সম্মান হরণ করল, তারা কি কখনো জবাবদিহি করবে? মোহাম্মদ ইকবালের পরিবার সে প্রশ্নের উত্তর জানে না। তারা শুধু আশা করে, মানুষ অন্তত একবার ভাববে—দাড়ি আর টুপি কোনো অপরাধ নয়।

No comments found