ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ সৃষ্টি করছে
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি দীর্ঘ ইতিহাসের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে, যেখানে দেশ দুটি একে অপরের কাছে প্রতিবেশী, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতির কারণে এই সম্পর্কের মধ্যে কিছু অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিশেষত, ভারত কখনও কখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে, যা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরক্তি এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে, কিছু বিশ্লেষক দাবি করেছেন যে ভারত বাংলাদেশের জনগণকে বিপথগামী করার চেষ্টা করছে, যা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস
ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী, বিশেষত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সাহায্য ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে ভারতীয় জনগণের সহানুভূতি এবং সাহায্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে, এর পাশাপাশি কিছু বিষয় যেমন তিস্তা নদী জলবণ্টন, সীমান্ত সমস্যা, সামরিক সহযোগিতা, এবং ২০০৩ সালের গ্যাস চুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল, যা কখনও কখনও সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
ভারতের প্রভাবের চেষ্টা
বিশেষত, ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে কিছু রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কারণে ভারতীয় প্রভাব বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধ মামলা চলছিল। ভারত, যা অতীতে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, কিছু পর্যবেক্ষণকারী দাবি করেছেন যে তারা এ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে চেয়েছে। ভারতের কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং বক্তব্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে দ্বিধাবিভক্ত মনোভাব সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া, বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিভাজনকে তীব্র করে দেওয়ার জন্য ভারত কখনও কখনও অতিরিক্ত ধর্মীয় নীতির প্রবর্তন করেছে, যার ফলে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মুসলিম জনগণের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ানোর চেষ্টা দেখা গেছে। ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে, বিশেষ করে ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (NRC) এবং সিএএ (সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন) ইস্যু বাংলাদেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এবং তাদের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব জাগিয়েছে।
ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা
ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ধর্মীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রায়ই আলোচনা করে থাকে, এবং কখনও কখনও সেই আলোচনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মতো মনে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মিডিয়া যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে খবর প্রচার করে, তখন তা জনমনে বিভ্রান্তি এবং সন্দেহ সৃষ্টি করে। ভারতের কিছু নিউজ আউটলেট, বিশেষ করে বাংলা মিডিয়া, কখনও কখনও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর বিশ্লেষণ প্রকাশ করে, যা কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ: কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে
ভারতের এই সকল পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ এবং অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মনে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করেছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন এবং মুসলিম জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা অনেক তীব্র হয়েছে, যা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রতি এক ধরনের সন্দেহ ও শঙ্কা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে এক ঐতিহ্য রয়েছে এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পছন্দ করে। কিন্তু ভারতের কিছু পদক্ষেপের ফলে ওই সম্প্রীতি এবং শান্তির প্রতি হুমকি তৈরি হয়েছে। বিশেষত, ভারতের বিভিন্ন রাজনীতিক নেতার মন্তব্য এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর জন্য ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি দেশের জনগণের কাছে আপত্তিকর হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
এতদিনের পর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া কিছুটা নরম হলেও সম্প্রতি এটি আরও কঠোর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের একাধিক সময়ের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তারা ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপকে সমর্থন করে না এবং সবসময় দেশের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় NRC ও CAA আইনের কারণে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছুবার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে এবং দাবি করেছে যে ভারতকে তার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি নিজস্ব সীমার মধ্যে সমাধান করতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণও একাধিক বার প্রকাশ্যে বলেছে যে তাদের জন্য দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতার প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা রয়েছে যা বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাবের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।
উপসংহার
ভারত যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে হস্তক্ষেপ করে, তবে তা দেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ এবং সন্দেহ তৈরি করতে পারে। ভারতীয় পদক্ষেপের ফলস্বরূপ বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কেবল দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকারক নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই, ভারতের উচিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সম্মান প্রদর্শন করা এবং উন্মুক্ত কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করা।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন, লেখক ও সাংবাদিক
No comments found



















