সুমন হাওলাদারঃ আই নিউজ বিডি| ০৫/০৬/২০২৫
নদী নয়, যেন মৃত্যুকূপ!
ঢাকার উত্তর-পূর্বে এক সময়ের জীবন্ত জলপ্রবাহ বালু নদী আজ মৃতপ্রায়। গাজীপুর থেকে বেরাইদ হয়ে শীতলক্ষ্যার দিকে এগিয়ে চলা এই নদী ছিল কৃষকের সেচের উৎস, জেলের মাছ ধরার ঘর আর পূর্ব ঢাকার প্রাণের প্রবাহ। আজ সেটি শুধুই হাহাকারের প্রতিধ্বনি।
দখল, দূষণ আর ঘাট-বিটের নামে নগ্ন চাঁদাবাজির থাবায় নদী হারাচ্ছে তার গতিপথ, গন্ধ, এমনকি অস্তিত্বও।
রাতের আঁধারে নদীর বুক চিরে পুঁতে দেওয়া হয় বাঁশ, টানা হয় দড়ি—চিহ্নিত করা হয় দখলের সীমানা। দিনভর চলে ইট, বালু, কংক্রিটের ব্যবসা। মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে থাকে আধাডোবা জাহাজ, গড়ে তোলা হয় বালুর পাহাড়, পতপত করে উড়ে দখলদারদের ‘পতাকা’। নদী যেন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, রীতিমতো ব্যক্তিগত সম্পত্তি!
"বিট না দিলে উঠাইবো না" — সরকারহীন নদীপথে চাঁদাবাজির রাজত্ব
প্রতিদিন বেরাইদ ঘাট দিয়ে পারাপার হন কয়েক হাজার মানুষ। অথচ নদী পার হতে তাদের দিতে হয় ৫ টাকা করে ‘বিট’। উৎসব-আয়োজনে সেই চাঁদা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ টাকা পর্যন্ত। রশিদ নেই, সরকারিভাবে অনুমোদিত কোনো টোল নেই—কেবল চাঁদাবাজের দম্ভ!
গৃহকর্মী সাবিনা বেগম ক্ষোভে বলেন—
“এই নদী পার হইতে ক্যান টাকা দিব? সরকার কইছে? কোনো কাগজ নাই, শুধু ভয় দেখায়। বিট না দিলে নৌকায় তুইলা না! আমরা কি দাস?”
৭২ বছর বয়সী বিমল চক্রবর্তী তীব্র হতাশায় বলেন—
“এক সময় এই নদীতে শবদাহ হইত, এখন হয় চাঁদাবাজির শবদাহ! বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা ওঠে এই ঘাট থেইক্কা—এই টাকা যায় কোথায়?”
নদীর পাড়ে গড়ে উঠছে দখল আর দূষণের জাল
বালু নদীর তীরে এখন সারি সারি মিক্সিং ফ্যাক্টরি, ওয়াশিং প্ল্যান্ট আর বালু বেচাকেনার ‘স্টেশন’। নদী যেন এক বিশাল জমি তৈরির কারখানা।
স্থানীয়রা জানান, প্রথমে বাঁশ পুঁতে নদীর বুক চিহ্নিত করা হয়। এরপর ফেলা হয় ট্রাকভর্তি মাটি—একটি ‘নতুন জমি’ বানানো হয় দিনে দিনে। এই প্রক্রিয়ার পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা দখল সিন্ডিকেট। রাতে চলে জমি তৈরি, দিনে চলে তার ব্যবসা।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই—প্রশাসন আছে, মাঠে নেই!
নৌপরিবহন আইন ২০১৭-এর ৭৬ ধারা স্পষ্ট করে বলে, সরকার ছাড়া কেউ নদীপথে টোল আদায় করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা? বেরাইদ ঘাটে এই আইন যেন অপ্রাসঙ্গিক কাগজপত্র মাত্র। নৌ অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিএ, থানা প্রশাসন—সব জায়গায় শুধু নীরবতা, কার্যত শূন্য।
বালু নদী: এক সময়ের লাইফলাইন, আজ অস্তিত্ব সংকটে
একসময় বালু নদী ছিল ঢাকার পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ ও অর্থনীতির প্রাণরেখা। সোনারগাঁও, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, বাড্ডা ও বেরাইদের গ্রামীণ জীবনযাত্রা এই নদীর ওপরই নির্ভর করত। ধান-চালের নৌকা, ডিঙ্গি ভেসে চলত মাছের খোঁজে, আর নদীর জলে খেলত শত শত শিশু।
আজ সেই সব স্মৃতি শুধুই অ্যালবামবন্দী। নদীর প্রবাহ স্তব্ধ, পানির রং কালচে, বাতাসে বর্জ্যের দুর্গন্ধ।
সমাধানের দিকনির্দেশনা: এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে!
পরিবেশবাদী, সচেতন নাগরিক ও স্থানীয়রা যেসব সুপারিশ তুলেছেন—
* ঘাট-বিট চাঁদাবাজি বন্ধে অবিলম্বে অভিযান
* দখলদারদের চিহ্নিত করে ফৌজদারি মামলা
* সরকারিভাবে ঘাট পরিচালনায় টোল নীতিমালা প্রণয়ন
* নদী রক্ষায় বাজেটসহ পৃথক প্রকল্প ঘোষণা
* “নদী পাহারা কমিটি” গঠনে স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা
* পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন
শেষ কথা: বালু নদী বাঁচানো মানেই ঢাকার পূর্বপ্রবাহ রক্ষা
নদী কেবল জল নয়, শহরের হৃদস্পন্দন। বালু নদীর মৃত্যু মানে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের মৃতপ্রবাহ।
আজ যে শিশুটি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকা দেখে, সে যেন আগামীকাল কোনো কংক্রিট প্রাসাদ দেখে না। আজই প্রশ্ন তুলতে হবে—এই নদী কার?
নদী বাঁচাও, শহর বাঁচাও।