সুমন হাওলাদার | আই নিউজ বিডি
এক সময়ের সজীব, প্রাণোচ্ছল বাড্ডা-সাতারকুলের খাল আজ দখল আর দূষণের বিষাক্ত ছোবলে বিলীন হওয়ার পথে। এটি শুধু একটি জলপথ ছিল না, ছিল এই অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধানক্ষেতে সেচ, মাছ ধরা, সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকা বাইচ—সবকিছুতেই মিশে ছিল এই খালের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। কালের বিবর্তনে সেই রূপ আজ শুধুই স্মৃতি, আর বর্তমান এক করুণ বাস্তবতা।
এক খালের বুকে কত গল্প!
প্রবীণদের স্মৃতিচারণে ভেসে ওঠে খালের সোনালী দিনগুলো। বর্ষায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত নৌকা বাইচের উন্মাদনা দেখতে ও শিশু-কিশোরদের সাঁতার প্রতিযোগিতায় মুখরিত হতো খালের পাড়। কৃষকদের জন্য এটি ছিল 'জলবাহিত আশীর্বাদ', যা শস্য শ্যামল করত ফসলের মাঠ। এই খালের ধার ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিল গ্রামীণ শহরতলির এক অনবদ্য ছন্দ।
খাল আজ শুধুই স্মৃতি: এক করুণ পরিণতি
অথচ আজ সেই খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোথাও তা বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়েছে, কোথাও পরিণত হয়েছে পচা দুর্গন্ধে ভরা আবর্জনার ভাগাড়ে। একসময় যেখানে শিশুদের কলহাস্য শোনা যেত, এখন সেখানে মশার উপদ্রব আর রোগের ভয়াল থাবা। প্রবাহ থেমে গেছে, জীবন্ততা উধাও—আছে কেবল দখলদারদের লোভ আর ধ্বংসের উন্মত্ততা।
দখলদারিত্বের সূক্ষ্ম কৌশল: ময়লা থেকে পাকা দালান
স্থানীয়দের বর্ণনায় উঠে আসে খাল দখলের এক ভয়াবহ চিত্র। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই দখল প্রক্রিয়া চলে। প্রথমে খালের পাড়ে ফেলা হয় আবর্জনা। এরপর সেই ময়লা ভরাট করে তৈরি হয় অস্থায়ী টয়লেট বা রান্নাঘর। সেখান থেকে টিনের ঘর, তারপর গ্যারেজ বা দোকান, এবং সবশেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় পাকা দালান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, খালের এই দখলকৃত অংশগুলো এখন বৈধ দলিলের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে, যেন খালের কোনো অস্তিত্বই ছিল না!
জলাবদ্ধতার অভিশাপ: বৃষ্টি মানেই বিপর্যয়
এক সময় এই খাল বাড্ডা, সাতারকুল, বেরাইদ ও উত্তর বাড্ডার জলাবদ্ধতা নিরসনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখত। কিন্তু আজ খালের অভাবে সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় হাঁটুপানি, রাস্তা ডুবে যায়, যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা ইলিয়াস মিয়ার আক্ষেপ, "আগে মাছ ধরতাম, এখন মশা ধরতে হয়। খাল ছিল আশীর্বাদ, এখন অভিশাপ।"
প্রশাসনের নীরবতা: নির্বিকার দর্শকের ভূমিকা
এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় দায় প্রশাসনের নীরবতা। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা কিংবা ভূমি অফিস—কেউই এই দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। মাঝে মাঝে লোক দেখানো কিছু অভিযান চালানো হলেও, কয়েকদিন পরই সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে আসে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা আসেন, ছবি তোলেন, জরিপ করেন, কিন্তু ফলাফল শূন্য। স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের আলোয়, প্রশাসনের চোখের সামনেই খালের ৫০ শতাংশেরও বেশি অংশ ইতিমধ্যেই বেদখল হয়ে গেছে।
এখনই সময়: খাল বাঁচানোর শেষ সুযোগ
বাড্ডা-সাতারকুলের এই খাল কেবল একটি জলাধার নয়, এটি একটি পরিবেশগত, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক সম্পদ। এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ না নিলে এই খাল পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, এবং তার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। সরকার, সিটি কর্পোরেশন এবং পরিবেশবাদীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই পারে এই খালকে পুনরুদ্ধার করতে। অন্যথায়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে—আমরা একটি নদীমাতৃক দেশের সন্তান হয়েও নিজেদের খাল বাঁচাতে পারিনি।
এই খাল কি সত্যিই বাঁচানো সম্ভব, নাকি এটি শুধুই অতীতের এক করুণ স্মৃতি হয়ে থাকবে?
চলবে...
পর্ব-৩, বাড্ডা: উন্নয়নের আড়ালে এক ধ্বংসযজ্ঞের শহর