এক দীর্ঘ আন্দোলন, জনমত এবং রাজনৈতিক চাপের মুখে অবশেষে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় সিদ্ধান্ত নিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জুলাই মাসে সংঘটিত গণহত্যা এবং ধারাবাহিক অপরাধের অভিযোগে সরকার দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে এই সিদ্ধান্তের ঠিক আগ মুহূর্তে শাহবাগ-যমুনাকেন্দ্রিক বিশাল আন্দোলনে বিএনপির অনুপস্থিতি জনমনে কৌতূহল ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত ৮ মে রাতে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে যমুনা সড়কে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। ছাত্র-জনতা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ছাত্রশিবির, খেলাফত মজলিস, লেবার পার্টি এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম এই কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ৯ মে জুমার নামাজের পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বিশাল বিক্ষোভ ও শাহবাগ অবরোধ করে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল—আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা এবং বিচারের আওতায় আনা।
বিএনপির অনুপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া:
তবে এসব কর্মসূচিতে বিএনপিকে দেখা যায়নি। যা নিয়ে আন্দোলনের মঞ্চে ও সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ফেসবুক পোস্টে বিএনপিকে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বিএনপি ছাড়া শাহবাগের ঐক্য পূর্ণ হবে না। এই শাহবাগ ভবিষ্যৎ রাজনীতির মানদণ্ড।” তবুও আন্দোলনের পুরো সময়জুড়ে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে মাঠে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা এসেছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, “আমরা কয়েক মাস আগে প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিতভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছি। মৌখিকভাবেও বলেছি, সভা-সেমিনারে বলেছি। আবার একই কথা বলতে শাহবাগে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
সরকারের সিদ্ধান্ত এবং আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া:
আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকে। বৈঠকের পর রাতেই সিদ্ধান্ত আসে—জুলাই গণহত্যার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শাহবাগ মোড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
কিন্তু আনন্দের সাথেই উচ্চারিত হতে থাকে বিএনপির বিরুদ্ধে স্লোগান—“আপনারা কোথায় ছিলেন?”
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, তারা আইনি প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করে এবং সে পথেই নিষিদ্ধকরণ দাবি করেছে।
বিএনপির নেতাদের ভাষ্য:
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন বলেন, “শুধু নিষিদ্ধ করলেই চলবে না। বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে জানান, “১০ ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টার হাতে দেয়া চিঠিতে আওয়ামী লীগকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করার দাবি জানিয়েছিলাম। ১৬ এপ্রিলও একই দাবি লিখিতভাবে জানিয়েছি। আমরা শুরু থেকেই বলছি, আইনি প্রক্রিয়াতেই নিষিদ্ধ করা সম্ভব ও উচিত।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ:
বিএনপির শাহবাগে অনুপস্থিতির পেছনে কৌশলগত কারণ আছে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অনেকে বলছেন, বিএনপি চায়নি সরকার বিরোধী যে কোনো আন্দোলনে ইসলামী দলগুলোর ছায়ায় নিজেদের অবস্থান দেখাতে। আবার কেউ বলছেন, দলটি হয়তো রাজনৈতিক পরিস্থিতির আরও পরিণত রূপ দেখার অপেক্ষায় আছে।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘোষণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিএনপি কি এই পরিস্থিতিতে মাঠে নামবে, নাকি আইনি লড়াইটিকে অগ্রাধিকার দেবে—সেটি সময়ই বলে দেবে।