খাদ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি নতুন নয়। কিন্তু অতীতের মতোই বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন করে ভাবাচ্ছে সবাইকে। এমনকি তাঁর ভূমিকা আগের দুই আলোচিত মন্ত্রী – সাধন চন্দ্র মজুমদার ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের কর্মকাণ্ডের সাথেও তুলনা করা হচ্ছে।
অতীতের খাদ্য মন্ত্রণালয় ছিল দুর্নীতির অভয়ারণ্য। মন্ত্রী কামরুল ইসলামের আমলে বদলি-পদায়ন ছিল বিশাল ঘুষ বাণিজ্যের কেন্দ্র। এরপর সাধন চন্দ্র মজুমদারের আমলে তা আরো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উপেক্ষা করে, মন্ত্রী সাধন জেলার ক্যাডার পদে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন। এখন সেই একই পথ ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে আলী ইমাম মজুমদারের ছেলে মাহমুদুল ইমাম টিপুর ভূমিকা। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার তদবির বাণিজ্য নিয়ে কথাবার্তা প্রায় ওপেন সিক্রেট। নানা সূত্র বলছে, এখন ঘুষের আরেকটি ‘চ্যানেল’ খুলেছেন আলী ইমাম, যা পরিচালিত হচ্ছে কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় লঙ্ঘন করে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহমান খানকে চাঁদপুরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের আয়ন-বায়নের দায়িত্ব দেওয়া। এটি এমন একটি পদ, যেখানে কেবলমাত্র ক্যাডার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। অথচ ডিজি হুমায়ুন কবীরের মাধ্যমে এই অবৈধ আদেশ বাস্তবায়ন করা হয়, যার পেছনে ছিল উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের প্রত্যক্ষ চাপ।
উল্লেখ্য, আব্দুর রহমান খান পূর্বেও বিতর্কিতভাবে কক্সবাজারের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে ছিলেন এবং সেখানেও তার মাধ্যমে ডিসি ফুডের দায়িত্ব পরিচালনা করা হয়েছিল, যা আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন ছিল। এরপর তাকে কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রাখা হলেও সম্প্রতি আবারও বিতর্কিতভাবে চাঁদপুরে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়।
এই প্রসঙ্গে ডিজি হুমায়ুন কবীর ও খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসানকে একাধিকবার প্রশ্ন করা হলেও তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, এই নীরবতা প্রমাণ করে দুর্নীতির অন্তরালে প্রশাসনের কতটা গভীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ঘটে আলী ইমাম মজুমদার উপদেষ্টা হওয়ার কয়েকদিন পরেই। তিনি তৎকালীন সৎ ও নির্লোভ ডিজি মো. আব্দুল খালেকের কাছে চান্দিনার উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক এনামুল হককে গাজীপুরের জয়দেবপুর এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পদায়নের অনুরোধ জানান। তবে জয়দেবপুর এলএসডি পদ দেশের সবচেয়ে ‘ঘুষসক্ষম’ এলএসডি পদগুলোর একটি, যেখানে এক একটি পদের মূল্য নাকি প্রায় ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ডিজি আব্দুল খালেক নানা জটিলতার পরও বিষয়টি খতিয়ে দেখেন, কারণ উপদেষ্টা বিষয়টি জোর করেই চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। এনামুল হক আবেদনপত্রে জানান, তাঁর বাবা-মা গাজীপুরে থাকেন – এটা পদায়নের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও সংশ্লিষ্ট মহল তা মানতে রাজি নয়। কারণ, গাজীপুর জেলায় আরো অনেক পদ রয়েছে, সেখানে নয়, কেন সরাসরি জয়দেবপুর – তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এই পদায়ন, ঘুষ দাবির প্রেক্ষাপট, সুপ্রিম কোর্টের রায় অমান্য, উপদেষ্টার ছেলের দাপট – সব মিলিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের বর্তমান অবস্থা নতুন সরকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। আদৌ কি এই অন্তর্বর্তী সরকার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে – নাকি অতীতের ধারাই অব্যাহত থাকবে? দেশের সচেতন জনগণ এখন সেই প্রশ্নই বারবার তুলছে।
নতুন সরকারের উপদেষ্টার এমন কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়, শুধু সরকার পরিবর্তন করলেই দুর্নীতির অবসান হয় না। যদি প্রশাসনিক কাঠামোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা হয়, তবে এই অবস্থা চলতেই থাকবে। আদালতের রায় লঙ্ঘন, তদবির বাণিজ্য এবং ঘুষের দাপট – সবই প্রমাণ করে খাদ্য অধিদপ্তরের পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি।