রাজধানীর চানখাঁরপুলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিরীহ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় অবশেষে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজ রোববার (২৫ মে) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে, যেখানে অভিযুক্ত করা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ৮ জনকে।
এই মামলাটিকে “জুলাই বিপ্লব”–এর প্রথম আনুষ্ঠানিক বিচার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ৮ জন অভিযুক্তকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। আজ সেটি ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।
অভিযুক্তদের পরিচয়:
এই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন—
-
ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান
-
সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী
-
রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ আলম ও মো. আখতারুল ইসলাম
-
রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল
-
শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন
-
কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন এবং মো. নাসিরুল ইসলাম।
তাদের মধ্যে চারজন বর্তমানে কারাগারে থাকলেও বাকিরা পলাতক রয়েছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘটনার পটভূমি:
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় চলছিল শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিল। সেদিন বিকেলে পুলিশ হঠাৎ করে মিছিলে গুলি চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, কোন ধরনের পূর্ব সতর্কতা বা উসকানি ছাড়াই সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সরকারি বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র, এপিসি কার, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রচুর পরিমাণ গুলি ব্যবহার করে জনসাধারণের ওপর হামলা চালান। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ছয় শিক্ষার্থী: শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদী হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক, এবং মানিক মিয়া শাহরিক।
তদন্ত প্রতিবেদনের চাঞ্চল্যকর তথ্য:
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্ত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে অধীনস্ত পুলিশ সদস্যদের গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ঘটনাটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত এবং সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে একধরনের ‘স্টেট টেররিজম’ প্রয়োগ করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আন্দোলনের সময় শুধুমাত্র টিয়ার গ্যাস বা জলকামান নয়, বরং যুদ্ধপর্যায়ের সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। হেলিকপ্টার থেকে পর্যবেক্ষণ, ড্রোনের মাধ্যমে শনাক্ত করে গুলি চালানো হয়—যা একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে।
আইনি বিশ্লেষণ ও আগামী প্রক্রিয়া:
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মামলাটি শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নজর কাড়বে। কারণ, এটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিরল এবং জটিল একটি হত্যাকাণ্ড মামলা।
ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবেন এবং তখন থেকেই শুরু হবে আনুষ্ঠানিক সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক।
শহীদ শিক্ষার্থীদের পরিবারের প্রতিক্রিয়া:
নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবার এই বিচার শুরুকে একটি “আশার আলো” হিসেবে দেখছেন। আনাসের মা সাংবাদিকদের বলেন, “আমার ছেলে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে গিয়েছিল, আর ফিরল লাশ হয়ে। আমরা অনেকদিন ধরেই বিচার চাইছিলাম। আজ একটু স্বস্তি পেলাম।”
চানখাঁরপুলের সেই রক্তাক্ত দিন আর শুধুই স্মৃতিতে নয়—এখন তা বিচার প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। জাতি এখন তাকিয়ে আছে আদালতের দিকে, ন্যায়বিচার মিলবে কি না তা দেখার অপেক্ষায়।