নতুন নীতির ধাক্কায় ৫ হাজার ট্রাভেল এজেন্সির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত!
বাংলাদেশের ট্রাভেল ব্যবসায় বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা নতুন খসড়া পরিপত্র কার্যকর হলে প্রায় পাঁচ হাজার ট্রাভেল এজেন্সি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হবে। সরকার ‘গ্রাহক হয়রানি প্রতিরোধের’ লক্ষ্যে এই পরিপত্র আনতে যাচ্ছে, যেখানে ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবি, এতে পুরো ট্রাভেল খাত এক ধরনের সংকটে পড়ে যাবে।
নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না।’ এতে করে দেশের প্রায় ৫ হাজার ৭৪৬টি লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে ৫ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় পড়েছে।
পরিপত্র নিয়ে বিতর্ক, কী বলছেন নীতিনির্ধারকরা?
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আতাউর রহমান এনডিসি জানান, ‘পরিপত্রের খসড়ায় অনেক কিছু থাকতে পারে, তবে এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা যাবে না। বিষয়টি যাচাই-বাছাই চলছে, এবং পরিপত্র জারি হলে বিস্তারিত জানা যাবে।’ তবে ট্রাভেল এজেন্সির মালিকরা মনে করছেন, এই নীতির ফলে ছোট ও মাঝারি ট্রাভেল এজেন্সিগুলো কার্যত দেউলিয়া হয়ে যাবে।
বিশ্বের প্রচলিত মডেলের ব্যত্যয়, বাজারে সিন্ডিকেটের আশঙ্কা
বিশ্বব্যাপী ট্রাভেল ব্যবসায় B2B (বিজনেস-টু-বিজনেস) মডেল প্রচলিত, যেখানে এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এই নিয়ম পরিবর্তন হলে ছোট-মাঝারি ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাজার কেবলমাত্র কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাবে। এতে করে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে দেশে মাত্র ৯৭০টি ট্রাভেল এজেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার মধ্যে মাত্র ৩৫০টি ট্রাভেল এজেন্সি বড় এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রির অনুমতি (ক্যাপিং) পেয়েছে। ফলে বাকি ৫,০০০ এজেন্সি টিকিট কেনার জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল। এই নতুন নীতির ফলে তারা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে না।
ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য কি কোনো বিকল্প থাকছে না?
নতুন নীতিতে ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনার জন্য আইএটিএর স্বীকৃতি নেওয়ার শর্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএটিএর অনুমোদন পেতে কয়েক বছর সময় লাগে এবং এর জন্য প্রচুর ব্যাংক গ্যারান্টি প্রয়োজন হয়। অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের পক্ষে এই শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে তারা ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়বে।
পর্যটন খাতের ভবিষ্যৎ কি?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই নীতি কার্যকর হলে বাংলাদেশের ট্রাভেল ও পর্যটন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যাত্রীরা টিকিট সংগ্রহে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন, কারণ বাজারে প্রতিযোগিতা কমে গেলে টিকিটের দাম বেড়ে যেতে পারে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান
মঈন ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মো. গোফরান চৌধুরী বলেন, ‘এই নীতির কারণে আমরা টিকিট সংগ্রহের সুযোগ হারাবো এবং ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বড় ট্রাভেল এজেন্সিগুলোই তখন পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে, যার ফলে এয়ার টিকিটের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে উঠবে।’
ট্রাভেল এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ট্যাব) সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে, নীতি পুনর্বিবেচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করতে। অন্যথায় দেশের ট্রাভেল ব্যবসার বড় অংশ বন্ধ হয়ে যাবে এবং হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।
সরকারের নতুন নীতি বাস্তবায়ন হলে দেশের ট্রাভেল খাতের বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী ও কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসায়ীদের দাবি, এই নীতির খসড়া চূড়ান্ত করার আগে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত সমাধান বের করা হোক। সরকার যদি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা না করে, তাহলে বাংলাদেশের ট্রাভেল খাত এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে।