“রাষ্ট্র চালানোর দায়িত্বে যারা আছেন, তারা আদৌ উদ্বিগ্ন কি না—সেটাই এখন প্রশ্ন। গার্মেন্টস খাতে ধস, বেকারত্ব ও অব্যবস্থাপনার ফলে ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ,” বললেন কানাডা প্রবাসী বিশ্লেষক শওগাত আলী সাগর।
৪০ বছরে এত খারাপ অবস্থা দেখিনি — ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশ অর্থনীতি: শওগাত আলী সাগর
বাংলাদেশ এখন এমন এক অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যা গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে সংকটপূর্ণ ও অনিশ্চিত বলে মনে করেন কানাডার বাংলা সংবাদমাধ্যম ‘নতুন দেশ’-এর প্রধান সম্পাদক ও বিশ্লেষক শওগাত আলী সাগর। শুক্রবার ইউটিউব চ্যানেল ‘অন্য মঞ্চ’-এর এক টকশোতে তিনি এই মন্তব্য করেন।
সাগর বলেন, “বর্তমানে যে অর্থনৈতিক উদ্বেগের কথা বলা হচ্ছে, সেটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক। এই উদ্বেগ এখন শুধুমাত্র অর্থনীতিকে ঘিরেই নয়, পুরো রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতিতেই রয়েছে।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তারা আদৌ এই সংকট নিয়ে চিন্তিত কি না? প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু নীতিনির্ধারকের বক্তব্যে বিষয়টিকে ট্রাম্পের ট্যারিফে নতুন সুযোগ বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু এই সুযোগ আদায় করার কোনো কৌশল আমাদের ছিল কি?”
সাগর বলেন, “২৯ জুলাই, অর্থাৎ মাসের একেবারে শেষ প্রান্তে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় রাউন্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অথচ এখনো স্পষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না—বৈঠকটি ভার্চুয়াল হবে, নাকি সরাসরি। বাণিজ্য উপদেষ্টা ও সচিবদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। এটা প্রমাণ করে যে, প্রস্তুতির অভাব রয়েছে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। এটি আমাদের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের যোগানদাতা এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ প্রায় ৪০ লাখ পরিবার ঝুঁকিতে রয়েছে।”
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “গত এক বছরে গার্মেন্টস খাতের ওপর সরকারি চাপ, শ্রমিক অসন্তোষ ও আন্তর্জাতিক ট্যারিফের কারণে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আরও ১০ লাখ চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে।”
তিনি বলেন, “আমরা এমন এক সময়ে পৌঁছেছি, যেখানে মার্কিন বাজারে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও চীন আগে থেকেই কৌশলগত প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এমনকি ভিয়েতনামের ক্ষমতাধর নেতারা সরাসরি ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেগোসিয়েশনের টিম গঠন করেছে। আমাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো স্ট্র্যাটেজিক প্রস্তুতি দেখা যায়নি।”
সাগর বলেন, “আমরা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে পাঠিয়েছি, যিনি ট্রেড নেগোসিয়েশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নন। এই ধরনের ভুল পদক্ষেপ আমাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তুলছে। এটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উদাসীনতা, নাকি ব্যর্থতা—সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে গার্মেন্টস রপ্তানিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় অবস্থানে। ভিয়েতনাম ও চীন আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ মার্কেট শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে। যদি আমরা মার্কিন ট্যারিফে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্কের মুখোমুখি হই, তাহলে ওই মার্কেট প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
শওগাত আলী সাগর বলেন, “বাণিজ্য নেতা এ কে আজাদ স্বীকার করেছেন যে, গত ৪০ বছরে ব্যবসার এত করুণ পরিস্থিতি তিনি দেখেননি। এই ধ্বংসাবশেষ কেবল তার একার ব্যবসার নয়, বরং পুরো দেশের অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। বিনিয়োগ নেই, রপ্তানি ঝুঁকিতে, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি স্থবির—এই অবস্থায় নতুন করে মার্কিন ট্যারিফ একটি ‘হাতুড়ি’ হয়ে দেশের মাথার ওপর এসে পড়েছে।”
শেষে তিনি বলেন, “যখন মাথার ওপর হাতুড়ি এসে পড়তে যাচ্ছে, তখন সরকার বলছে—‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এই উদাসীনতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সামনে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না।”