৩১৭২ কোটি টাকার ইভিএম কেলেঙ্কারিতে সাবেক সিইসি নূরুল হুদা ঘিরে দুদকের অনুসন্ধান..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
নূরুল হুদার আমলে ৩১৭২ কোটি টাকার দুর্নীতি ও ‘ভোট জালিয়াতির’ অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। অস্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে এবার জবাবদিহির মুখে সাবেক সিইসি।..

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে এবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করেছে। গুরুতর দুইটি অভিযোগ ঘিরে এ তদন্ত। প্রথমত, ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেড় লাখ নিম্নমানের ইভিএম কিনে রাষ্ট্রের ৩১৭২ কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগ। দ্বিতীয়ত, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি ও নির্বাচনী কারচুপির ঘটনায় তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা।

দুদকের কাছে আসা অভিযোগ বলছে, সিইসি থাকা অবস্থায় নূরুল হুদা ও তার সহযোগীরা কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন। যেখানে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে, বাজার মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ দামে, দেড় লাখ নিম্নমানের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হয়। এ প্রকল্পে দেশের রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩১৭২ কোটি টাকা।

এই কেনাকাটায় টেন্ডার প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নেওয়া হয়—এমন অভিযোগও আছে।

শুধু ইভিএম কেনাই নয়, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগেও তদন্ত করছে দুদক। অভিযোগে বলা হয়েছে, সে সময় নূরুল হুদা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ওসি এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় নির্বাচনী ফলাফল ‘প্রভাবিত’ করেন।

তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, র‍্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ হাতে পেয়েছে দুদক।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জানান, ইতোমধ্যে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডও উদ্ধার করা হয়েছে।

দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ৭ সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল। তারা যেসব ব্যক্তি বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে এবং বিচার-বিশ্লেষণ শেষে কমিশনের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে, এই অভিযোগগুলো তদন্তে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৫৭টি আসন পেয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। তবে সেই নির্বাচন ঘিরে শুরু থেকেই ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ছিল। বিরোধীদলগুলোর দাবি, অধিকাংশ ভোট আগের রাতেই দিয়ে দেওয়া হয়। এই ভোট নিয়ে এতটাই বিতর্ক হয় যে, অনেকেই একে নাম দেন “নিশি রাতের নির্বাচন”।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিদায়ী সাক্ষাৎকারে বলেন, “একাদশ জাতীয় নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি।” তার মতে, জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হওয়ায় তারা সরকারের মনোনীত প্রার্থীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন।

নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশের দ্বাদশ সিইসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হয় তার মেয়াদ। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।

বিশেষ করে একাদশ নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে, যা গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণের মনে প্রশ্ন তোলে—এই নির্বাচন আদৌ স্বচ্ছ ছিল কি না।

২০০৮ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর পর থেকে তিনটি নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে হয়।

বিরোধীদের দাবি, এই তিনটি নির্বাচনেই সরকার ক্ষমতা ব্যবহার করে ভোটের ফলাফল নিশ্চিত করেছে। এই পটভূমিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে।

এরপর হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয়, যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়।

রায়ে বলা হয়—জনগণের আস্থা বিনষ্ট করে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত না করায় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে।


সাবেক সিইসি নূরুল হুদার আমলে ইভিএম দুর্নীতি ও ‘ভোট জালিয়াতি’ তদন্তে এবার একপ্রকার আইনি জালেই আটকানোর পথে তদন্ত সংস্থা দুদক। ভোটাধিকার হরণ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, উভয় ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছেন তিনি। এবার তাকে হয়তো আদালতেই জবাবদিহি করতে হতে পারে।

No se encontraron comentarios