২০০৯ থেকে ২০২৪: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি, অনিয়ম, খুন ও গণহত্যার কালো ছায়া


২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশজুড়ে নানা বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে যা দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময়কালে দুর্নীতি, প্রশাসনিক অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং গণহত্যার অভিযোগ উঠে এসেছে যা সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা শেখ হাসিনার শাসনামলের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনাকে বিশ্লেষণ করব যা দেশব্যাপী আলোচিত এবং সমালোচিত।
১. দুর্নীতির কালো ছায়া
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। বিশেষ করে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ঋণ বন্ধ করে দেয়, যা দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। যদিও সরকার পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়, তবু দুর্নীতি দমন কমিশনের অসংগতিপূর্ণ কার্যক্রম এবং বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এছাড়া ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি এবং আর্থিক খাতে লুটপাটের ঘটনাও এ সময় ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ আত্মসাত এবং ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব দুর্নীতির ফলে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
২. প্রশাসনিক অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার
শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগও উঠেছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সরকারপক্ষের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি প্রদান, এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপে সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রায়শই শোনা গেছে।
বিচার বিভাগের উপর সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগও এ সময় ব্যাপকভাবে উঠেছে। বিশেষ করে, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা এবং বিচার কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। এসব ঘটনা দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম
শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে, র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) এবং পুলিশ বাহিনী দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ বার বার উঠেছে। এমনকি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
গুমের ঘটনাও এ সময় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং সামাজিক আন্দোলনের নেতাদের গুম করার অভিযোগও উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তিদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, যা সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনমনে ভয় এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে।
৪. গণহত্যার অভিযোগ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন
জুলাই গণহত্যা এবং ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় পুলিশ এবং র্যাব বাহিনীর কঠোর ব্যবহারের কারণে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। এ ঘটনাকে অনেকেই গণহত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
এছাড়া, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা কঠোর আচরণ করে, যার ফলে দেশজুড়ে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ জনগণের সংঘর্ষে অনেকেই আহত এবং নিহত হন।
৫. সংকটকালীন সময়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও সমালোচনা
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে ওঠে। সরকারের সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে মুক্তমত এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং সামাজিক মিডিয়ায় সক্রিয় ব্যক্তিদের হয়রানি করা হয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলকে অনেকেই উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সময় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তবে, এই শাসনামলের সময়কালে সংঘটিত নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও নিন্দিত হয়েছে। এসব অভিযোগ শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি জনমনে এক ধরনের ভয়, সংশয়, এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও সরকারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সুশাসন, মানবাধিকার, এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এসব ঘটনা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
कोई टिप्पणी नहीं मिली