এক সময় যে পুলিশ বাহিনী ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান, সেই বাহিনীর পেশাদারিত্ব আজ ভেঙে পড়েছে এক ভয়ঙ্কর দুর্দশায়। সদ্যসমাপ্ত জুলাই বিপ্লবে সবচেয়ে বেশি জনরোষের শিকার হয়েছে পুলিশ বাহিনী। গুলি, হামলা ও ভবন ভাঙচুরে প্রতিটি স্তম্ভ কেঁপে উঠেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপর্যয়ের পেছনে দায়ী ১২টি ভয়াবহ ব্যর্থতা, যার মাধ্যমে একটি পুরো বাহিনী রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপ নিয়েছিল।
পুলিশকে জননির্যাতনের হাতিয়ার বানানো হয়
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশকে ব্যবহার করেছে নজরদারি ও দমনপীড়নের যন্ত্র হিসেবে। ফলে পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দিনকে দিন বাড়তে থাকে। পেশাদারিত্বকে ছাপিয়ে তারা হয়ে ওঠে ‘রাজনৈতিক যন্ত্র’।
নিয়োগে ঘুষ আর দলীয়করণ
পুলিশের একাধিক ডিআইজি জানাচ্ছেন, আওয়ামী শাসনামলে বিসিএসসহ অন্যান্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। মেধাবীদের বাদ দিয়ে যোগ্যতাহীন ক্যাডারদের তোলা হয়েছে শীর্ষপদে। এমনকি প্রশিক্ষণেও পাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে অযোগ্যদের, যা বাহিনীর ভিত্তিকে নড়বড়ে করেছে।
পদের বিপরীতে নিয়োগ, শূন্যতা উপেক্ষিত
পদ না থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দলীয় অনুগতদের। স্বাভাবিকভাবে অবসর, মৃত্যু বা পদত্যাগের পর শূন্য পদ পূরণের নিয়ম থাকলেও তা লঙ্ঘন করে রাজনৈতিকভাবে পুলিশে ঢোকানো হয়েছে শত শত ক্যাডার।
অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগ ও স্নাইপারের ব্যবহার
আইন না মেনেই দাঙ্গা দমন বা গণজমায়েতে ব্যবহার করা হয়েছে চাইনিজ রাইফেল, রাবার বুলেট, এমনকি স্নাইপারও। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক মানুষ। পুলিশের মানবাধিকারের লঙ্ঘনজনিত কাজ বেড়েছে চোখে পড়ার মতোভাবে।
বদলি ও পদোন্নতিতে উন্মুক্ত ঘুষের বাজার
পদায়ন ও পদোন্নতিতে চলে ঘুষের বড়সড় সিন্ডিকেট। কনস্টেবল থেকে শুরু করে ডিআইজি—সব স্তরেই ঘুষ ছাড়া কিছু হয় না। এতে পেশাদার কর্মকর্তারা পিছিয়ে পড়েন, আর ঘুষদাতা কর্মকর্তারা হয়ে ওঠেন জনদুর্ভোগের প্রতীক।
গায়েবি মামলা আর রাজনৈতিক হয়রানি
বোমা বা বিস্ফোরণ না ঘটলেও বানানো হয় মামলা। এলাকা থেকে স্কচটেপ, জর্দার কৌটা এনে ‘আলামত’ বানিয়ে দেওয়া হয় ফরমায়েশি অভিযোগপত্র। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হতো। এমনকি সাজা পাওয়ার হার ৮%–এর নিচে নেমে এসেছে।
থানাকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য
অনেক থানার ওসি ও কর্মকর্তারা দলীয় মদদে এলাকায় গ্রেপ্তার বাণিজ্য ও মামলা দিয়ে টাকা আদায়ে লিপ্ত। থানার ক্ষমতা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখা হতো, যা পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে চূড়ান্তভাবে।
কমিউনিটি পুলিশিংয়ের নামে ক্যাডার নিয়োগ
জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে গঠিত কমিউনিটি পুলিশে সদস্য করা হয়েছে চাঁদাবাজ ও দলীয় ক্যাডারদের। যারা থানার সহযোগিতায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও হয়রানির কাজে যুক্ত ছিল।
চেইন অব কমান্ড ধ্বংস
ওসি থেকে এসপি—সবাই নিজের রাজনৈতিক পরিচয় জাহির করতেন। কেউ কারও কথা শুনতেন না। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হতো। এতে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো ভেঙে পড়ে।
বিশেষ জেলার আধিপত্য
গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ পদগুলো দখলে রেখেছেন। এতে অন্যান্য জেলার মেধাবীরা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন। এই বৈষম্য পুলিশ বাহিনীর ভারসাম্য ও সৌহার্দ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
শক্তিশালী সিন্ডিকেট: রাজনীতিবিদদের ছায়ায়
সাবেক আইজিপি, কমিশনার, ডিআইজি পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা গঠন করেছেন সিন্ডিকেট। তারা বদলি, নিয়োগ, কেনাকাটা, এমনকি মামলার তদন্ত পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেছেন দলীয় স্বার্থে।
শাস্তির বদলে পদোন্নতি
যারা অপকর্মে জড়িত ছিলেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। একাধিক বিতর্কিত কর্মকর্তা আজও উচ্চ পদে বহাল। এতে করে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে দুর্নীতির সংস্কৃতি বৈধতা পেয়েছে।