১ জুলাই প্রায় ১৬ বছরের আ.লীগ শাসন পতনের অভূতপূর্ব সূচনা

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
১ জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া একটি অভূতপূর্ব গণবিপ্লব। এটাই হয়ে ওঠে ১৬ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে ইতিহাসের এক ভয়াল প্রত্যাঘাতের সূচনা।..

২০২৪ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিন হিসেবে স্থান করে নেয়। এই তারিখে ঘটে যায় এক চমকপ্রদ অধ্যায়—একটি সাধারণ কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় এক ভয়াল ছাত্রবিপ্লবে, যা ১৬ বছরের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সমাজ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদে গড়ে ওঠা এই 'জুলাই বিদ্রোহ' আজ অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের প্রতীক।

আন্দোলনের সূচনা হয় ৫ জুন, যখন হাইকোর্ট ২০১৮ সালে বাতিল হওয়া কোটা পুনর্বহাল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ভাষ্যমতে, তিনি চানখারপুলে স্কুটি মেরামতের সময় ফেসবুকে রায়ের খবর দেখে হতবাক হন। তার ভাষায়, “মনে হলো ২০১৮ সালের সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।”

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক বৈঠক ডাকা হয়। সেদিন রাত সাড়ে ৭টায় বের হয় প্রথম মিছিল, যেখানে হাইকোর্টের রায়কে 'মেধাবীদের সঙ্গে তামাশা' আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরদিন ৬ জুন রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ডাক দেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা চারটি দাবি উত্থাপন করেন:

  1. পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা নিশ্চিত রেখে কমিশন গঠন।

  2. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা।

  3. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা বন্ধ করা।

  4. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না আসায় ১ জুলাই দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাবি, জাবি, চবি, রাবি, জগন্নাথ, বরিশাল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন একযোগে বিস্তৃত হয়। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মহাসড়ক অবরোধের সংবাদও আসে।

সরকার শুরুতে পরিস্থিতি ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেও পরে শক্তি প্রয়োগে মনোযোগী হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একত্রে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় অন্তত ১,৪০০ শিক্ষার্থী নিহত হন এবং আহত হন ২০,০০০-এর বেশি। ১৯৭১-এর পর এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ছাত্র হত্যাকাণ্ড।

আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র আসিফ মাহমুদ তার লেখা "জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু" বইতে বলেন, “ঈদের ছুটির সময় আমাদের হাতে মাত্র তিন দিন ছিল। আমরা জানতাম, সরকার যদি এই তিন দিনের মধ্যে সাড়া না দেয়, আমরা দানবীয় প্রতিরোধ গড়ে তুলব।”

আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে তিনি উল্লেখ করেন কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে লাইব্রেরির সামনের বৈঠক—সবকিছু নিয়েই এই বইয়ে ফুটে ওঠে একটি ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাস।

এই বিদ্রোহ শুধু একটি ছাত্র আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল এক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক বিপ্লব। ২০০৮ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবারের মতো এক ভয়াবহ গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিদ্রোহই ছিল আওয়ামী লীগের পতনের প্রকৃত সূচনা।

বিশেষ করে যারা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফসল হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন, তাদের কাছে ২০২৪ সালের এই আন্দোলন ছিল déjà vu। কিন্তু এবার আন্দোলনের ভয়াবহতা ও বিস্তার ছিল অনেক বেশি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘জুলাই বিদ্রোহ’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এক দিকনির্দেশক অধ্যায়। এটি দেখিয়ে দিয়েছে, জনতার কণ্ঠ কখনোই চিরতরে দমন করা যায় না।

নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব আজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হলেও তারা এখনো ছাত্র রাজনীতির আদর্শ ও গৌরব ধরে রাখার প্রতীক।

‘জুলাই বিদ্রোহ’ আজ আর শুধুই একটি আন্দোলনের নাম নয়। এটি হয়ে উঠেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের গর্জনের প্রতিধ্বনি। ইতিহাসে এমন দিন গুটিকয়েকই আসে, যেগুলো একটি প্রজন্মের আত্মপরিচয় গড়ে দেয়—১ জুলাই ঠিক তেমনই একটি দিন।

没有找到评论


News Card Generator