'আইনহীন' শহর: লারিনকোন্ডায় সোনা ও অপরাধের জন্য জীবনের ঝুঁকি, শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে ২৫ হাজার মানুষের বাস..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
আলচারি (Alchery) পদ্ধতি: লারিনকোন্ডায় ভাগ্য ও পরিশ্রম উভয়ই সোনা পাওয়ার প্রধান মাপকাঠি। এখানে অনেকেই সপ্তাহ বা মাস ধরে কাজ করে ভাগ্য পরীক্ষা করে।..

পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার ওপর, মেঘের থেকেও উঁচুতে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,১০০ মিটার (প্রায় ১৬,৭০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত লারিনকোন্ডা। এই শহরটিকে কেবল পৃথিবীর উচ্চতম জনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবেই নয়, বরং বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও 'আইনহীন' শহরগুলোর মধ্যে একটি হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। অক্সিজেনের চরম ঘাটতি, পারদ-দূষণ এবং তীব্র অপরাধপ্রবণতার মধ্যেই ২৫ হাজার মানুষ এখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করে—কারণ একটাই: সোনা।

'অক্সিজেন নেই, আইন নেই, শুধু সোনা'—এই তিনটি বিষয়ই লারিনকোন্ডার পরিচয়। এখানে বাতাসের অক্সিজেনের মাত্রা পৃথিবীর অন্যান্য শহরের তুলনায় প্রায় ৫০% কম, যা মানবদেহের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এই চরম প্রতিকূল ও বিষাক্ত পরিবেশে মানুষ আসে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। মানব পাচার, অপহরণ, সশস্ত্র ডাকাতি এবং খুন এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই শহরটি সোনা শিকারিদের জন্য 'পেরুর আইন বহির্ভূত শহর' হিসেবে পরিচিত।

স্বাস্থ্যের চরম ঝুঁকি ও দূষণ

  • অক্সিজেনের ঘাটতি: লারিনকোন্ডায় বাতাসের অক্সিজেনের মাত্রা এত কম যে এখানকার বাসিন্দাদের ফুসফুস দ্রুত কাজ করে এবং হৃদযন্ত্রকে দ্রুত গতিতে রক্ত পাম্প করতে হয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। স্বাভাবিক রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা যেখানে ৯৪% থেকে ৯৯% হওয়া উচিত, সেখানে এই শহরের বাসিন্দাদের শরীরে এটি বিপজ্জনকভাবে ৭০%-এর আশেপাশে থাকে।

  • পারদ দূষণ: এই শহরের চারপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে পারদ (Mercury) দ্বারা দূষিত। খনি থেকে পাথর থেকে সোনা আলাদা করার জন্য পারদ ব্যবহার করা হয়, যা বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসকে বিষাক্ত করে এবং স্থানীয় জলপথ ও হ্রদের পানিকেও পারদের বিষে নীল করে তোলে। এই দূষণের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।

  • জঙ্গলের অভাব: এই উচ্চতায় কোনো গাছ বা জীবন নেই। এছাড়া, এখানে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই, ফলে আবর্জনা ও বর্জ্য সর্বত্র ছড়িয়ে থাকে।

আইনহীন জীবন ও অপরাধের প্রাদুর্ভাব

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই লারিনকোন্ডার পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এখানে সশস্ত্র ডাকাতি, অপহরণ এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের পাচারের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়ে পেরু বা বলিভিয়ার অন্য শহর থেকে মেয়েদের আনা হয় এবং তাদের পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নিয়ে এখানে আটকে রাখা হয়।

  • খনি মালিকানা ও সহিংসতা: প্রতিটি সোনার খনি আলাদাভাবে কোনো একজন মালিক দ্বারা পরিচালিত হয়। অনুমতি ছাড়া কোনো খনিতে প্রবেশের চেষ্টা করলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়, এমনকি মেরে লাশ ঝুলিয়ে রাখার মতো সতর্কতাও এখানে দেখা যায়।

  • 'পাগা কুইরাস' প্রথা: স্থানীয়রা বিশ্বাস করে, একটি সুন্দর বরফে মোড়া পাহাড়ে এক নারী আত্মা বাস করে। এই আত্মা সোনা নিয়ে ঈর্ষান্বিত হয় এবং নারীরা খনির ভেতরে প্রবেশ করলে রুষ্ট হয়। তাই ঐতিহ্যগতভাবে নারীদের খনি থেকে খনন করতে দেওয়া হয় না। তারা খনির বাইরে পড়ে থাকা পাথরের মধ্যে সোনা খোঁজে।

সোনা সংগ্রহের প্রক্রিয়া

  • আলচারি (Alchery) পদ্ধতি: লারিনকোন্ডায় ভাগ্য ও পরিশ্রম উভয়ই সোনা পাওয়ার প্রধান মাপকাঠি। এখানে অনেকেই সপ্তাহ বা মাস ধরে কাজ করে ভাগ্য পরীক্ষা করে।

  • শ্রমিকের ভাগ: খনি শ্রমিকরা সপ্তাহে প্রায় ৫০ গ্রাম সোনা উত্তোলন করলে সেটিকে খনি মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে ৫০% করে ভাগ করা হয়। এর থেকে তারা সপ্তাহে প্রায় ৩,০০০ ডলার পর্যন্ত উপার্জন করতে পারে।

  • হোটেল ও বাণিজ্য: যেহেতু দূরদূরান্ত থেকে লোকেরা এখানে আসে, তাই শহরে রাত কাটানোর জন্য প্রচুর হোটেল তৈরি হয়েছে, যদিও সেগুলোতে হিটিং-এর ব্যবস্থা নেই। শহরে বহু জায়গায় সোনার বিনিময়ে নগদ অর্থ প্রদান করার দোকান রয়েছে।

No comments found


News Card Generator