Ranajit Kumar Barman
প্রকাশ ০৮/০৩/২০২২ ১০:৪৮এ এম

জীবন সংগ্রামে জয়ী নারী চন্দ্রিকা

জীবন সংগ্রামে জয়ী নারী চন্দ্রিকা
মুখে হাসি হাতে কাজ এটি হল প্রধান সাজ। কেউ বলে দিদি, কেউ বলে মুন্না আবার কেউ বলে চন্দ্রিকা । সদা সর্বদা মুখে প্রাণ ভরা হাসি । এই প্রাণ চাঞ্চল্যভরা হাসি দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করে বলেন মনে হয় হাসির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কোন অন্ত বেদনা। কাজকেই তিনি মনে প্রানে ভালবাসেন। আর এ কারণে শুধু নিজের প্রতিষ্ঠান নয় পরিবারেরও সকল সুবিধা অসুবিধা দেখভাল করে থাকেন। এই ব্যক্তিটি হল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সদরের নারী সংগঠন নকশীকাঁথার পরিচালক চন্দ্রিকা ব্যানার্জী(৫৪)। তিনি শুধু পরিবার নয় প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মী ও সকল উপকারভোগীদেরকেও পরিবারের সদস্যদের মত ভেবে থাকেন। আর এ ভাবনার জন্য তাকে দিনরাত ছুটে চলতে চলতে কখনও কখনও হঠাৎ করে বিছানায় শর্য্যা শায়ী হতে হয়। তিনি দীর্ঘ দিন যাবত শরীরে টিউমার,ইউরিন সমস্যা,ডায়াবেটিকস রোগ সহ অন্যান্য সমস্যা নিয়ে ভুগছেন। এ জন্য তাকে অসুস্থতাজনিত কারণে হঠাৎ হঠাৎ করে চিকিৎসার জন্য ভারতে গমন করতে হয়।

চন্দ্রিকা ব্যানার্জীর কর্মময় জীবনে সফলতার জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে , স্কুল কলেজ ও বেসরকারী সংগঠনের তৈরী অনেক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য,উপজেলা চেয়ারম্যান,উপজেলা নির্বাহী অফিসার,সকল ইউপি চেয়ারম্যানবৃন্দ সহ সকল স্তরের মানুষের সাথে রয়েছে সুসম্পর্ক।

জানা যায় তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য,উপজেলা জলমহল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য,উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য,উপজেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক,সুন্দরবন বালিকা বিদ্যালয়ের যেীন হয়রানী প্রতিরোধ কমিটির সদস্য,বেসরকারী সংগঠন সুশীলনের কার্যকরী কমিটির সভাপতি,শ্যামনগর সদর ইউপির বিভিন্ন কমিটির সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করা সহ এ রকম ৩০টির অধিক কমিটির সদস্য পদে রয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে এলাকার নারীদের সমস্যা নিয়ে নিজেই বিভিন্ন পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যেমন উপকুলীয় নারীদের স্বাস্থ্য গত সমস্যা, উপকুলীয় এলাকায় সুপেয় পানির প্রাপ্যতা সহ অন্যান্যা বিষয়ে। উন্নয়ন মুলক কাজে অবদানের জন্য তিনি জয়িতা পুরস্কার,সফল সংগঠকের পুরস্কার পেয়েছেন। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পল্লী উন্নয়ন স্বর্ন পদক-২০১৩ গ্রহণ করেছেন ২০২১ সালে। যেখানে ছিল সোনার মেডেল , সনদ সহ অন্যান্য কিছু। এ ছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সফলতার কাহিনী বর্ণনা করা সহ পত্র পত্রিকায় সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। তিনি সব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা পছন্দ করেন। আর তাই সকালে বা রাত্রে বসে দিনের আবার সপ্তাহের কর্ম পরিকল্পনা গুলি লিপিবদ্ধ করেন এবং সে অনুযায়ী বাস্তবায়িত কাজ গুলি দিন শেষে লিষ্ট থেকে বাতিল করে দেন।

জীবনে চলার পথে ত্যাগকেই প্রাধ্যান্য দিয়ে থাকেন। উদহারণস্বরুপ বলা যেতে পারে ঈদুল ফিতর ও শীরদীয়া দূর্গা উৎসবের সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আয়ের একটি বৃহত অংশ ব্যয় করে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দরিদ্র শিক্ষার্থী ও অন্যান্যদের সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা করে থাকেন। তার এ সফলতার স্বীকৃতি স্বরুপ দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের সহায়তার সুইডেন ,ডেনমার্ক,সুইজারল্যান্ড ভ্রমন করেছেন। এ ছাড়া অন্যান্য বেসরকারী সংগঠনের সহায়তায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে উন্নয়ন মুলক প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন।

তিনি আজও নিজের তথা পরিবারের জন্য একটি আশ্রয়স্থল বানাতে পারেননি। বর্তমানে থাকেন ৪ সদস্য পরিবারের সকলে মিলে বাসা ভাড়া করে।
চন্দ্রিকার পিতা মৃত অনিমেষ ব্যানার্জী ছিলেন একজন বিশিষ্ট গীটার বাদক,সুরকার ,গীতিকার ও সঙ্গিত শিল্পী। তিনি খুলনা বেতারে দীর্ঘ দিন যাবত শিল্পী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অনিমেষ ব্যানার্জীর সঙ্গিত ছাত্র রয়েছেন। মাতা দিপালী ব্যানার্জী কলকাতার একটি হাসপাতালে মারা যান। চন্দ্রিকা ব্যানার্জী, রিয়া ব্যানার্জী ও কেয়া ব্যানার্জী নামে তিন বোন। অনিমেষ ব্যানার্জীর কোন পুত্র সন্তান নেই। প্রথম সন্তান হিসাবে প্রথমে খুব আদর ¯েœহ পেলেও পরবর্তীতে আরও ২টি বোন হওয়ার কারণে নিজের মা ও তাকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।

চন্দ্রিকা খুব ছোট বেলা থেকে জীবন যুদ্ধ করে আসছেন বলে জানান। জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য স্কুল জীবনে লেখা পড়া করা কালীন সময়ে তার পছন্দের ছেলে নকিপুর গ্রামের তপন কুমার কর্মকারকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরেই সব সুখ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করলেও সে সুখ তিনি পাননি বলে জানান। ছোটবেলা থেকে যে দুরন্তপনা ভাবে চলে এসেছিল সেটা একবারে থেমে গেল বিয়ের পর। স্বামীর ও শ^শুর শাশুড়ীর বেঁধে দেওয়া নিয়মের মধ্যে চলা ফেরা করতে যেয়ে তার জীবন যেন নাভিশ^াস হয়ে উঠতে লাগল। তাই এই বাঁধা ধরা জীবন থেকে মুক্তি পেতে এক মাত্র পুত্র সন্তান অনিরুদ্ধ কর্মকার সম্পদকে নিয়ে বাইরে বের হওয়ার সুযোগ খুঁজে ছিলেন প্রথমে।

পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকায় কাজের ক্ষেত্র খুঁজতে লাগলেন। চন্দ্রিকা কাপড়ে হাতের তৈরী নকশা করা ,সেলাই করা সহ অন্যান্য হাতের কাজ ভাল ভাবে শিখেছিলেন। তাই নিজে ভাবলেন কাপড়ে সেলাই করে,ব্লক বাটিক এর কাজ করে আয় করা সম্ভব আর এ ভাবনা থেকেই কার্যক্রম শুরু করলেন নিজ বাড়ীর বারান্দায়। এ কার্যক্রম দেখে গ্রামের মহিলারা তার কাছে কাজ শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং সেভাবে উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহায়তায় একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। তিনি ভাবলেন এ সকল মহিলাদের নিয়ে একটি নারী সংগঠন করলে নারীরা উপকৃত হবেন। আর তার ভাবনার ফল স্বরুপ ১৯৯৩ সালে জন্ম হয় নারী সংগঠন নকশীকাঁথা।

সংগঠনটি তৈরীর ক্ষেত্রে বা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি ভাবলেন একা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তখনই গ্রামের নারীদের একত্রিত করে হাটি হাটি পা পা করে আজ নকশীকাঁথা উপজেলা ,জেলা তথা বিভাগের মধ্যে উন্নয়নশীল নারী সংগঠন হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে প্রগতির পরিচালক সাবেক অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহী,সাংবাদিক ও শিক্ষক রনজিৎ বর্মন এবং স্বামী তপন কুমার কর্মকার,সামছুন্নাহার সহ অন্যান্যদের অবদানের কথা উল্লেখ করেন। নকশীকাঁথা উপকুলীয় শ্যামনগরে সুপেয় পানি, শিশু শিক্ষা, কৃষি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, আয় সৃষ্টি মুলক প্রকল্পে নারীদের সম্পৃক্ত করণ, হস্ত শিল্প , আইসিটি প্রশিক্ষণ প্রদান সহ অন্যান্য উন্নয়নমুলক কাজ বাস্তবায়ন করে চলেছে।

চন্দ্রিকা ব্যানাজী বলেন এলাকার নারীদের কথা চিন্তা করে শ্যামনগরে একটি বৃদ্ধাশ্রম করা প্রয়োজন। যেটিতে শেষ বয়সে অনেক মহিলা আশ্রয় নিয়ে ভাল দিন যাপন করতে পারবেন। এ জন্য তিনি সরকারি বেসরকারী সহায়তার আশা প্রকাশ করেন। হাস্যেজ¦ল চন্দ্রিকার স্বপ্ন তিনি না থাকলেও নকশীকাঁথা যেন তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারে এ জন্য সকলের নিকট দোয়া কামনা করেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত সংবাদ