অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অডিও ফাঁস হয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝরের প্রকাশ করা ওই অডিওতে কমিশন বাণিজ্য নিয়ে কথোপকথন শোনা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে গুরুতর টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগকে ঘিরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে চরম তোলপাড় শুরু হয়েছে। অভিযোগের মূল ভিত্তি হলো একটি অডিও ফাঁস, যেখানে কথিতভাবে মাহফুজ আলমকে বিভিন্ন কমিশন বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে শোনা গেছে। সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর তাঁর ফেসবুক আইডিতে এই অডিও প্রকাশ করার পর মুহূর্তেই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
গত বুধবার রাতে নিজের ফেসবুক ওয়ালে অডিওটি প্রকাশ করেন জাওয়াদ নির্ঝর। তিনি দাবি করেন, এই অডিওর কণ্ঠস্বর মাহফুজ আলমের, যিনি বর্তমানে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নির্ঝর আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি মাহফুজ আলমের কললিস্ট ও কার্যক্রম নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। তাঁর অভিযোগ অনুযায়ী, মাহফুজ আলম শুধু দেশের ভেতরেই নয়, দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট ও বিনিয়োগ কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছেন।
অডিওটিতে শোনা যায়, মাহফুজ আলম টেন্ডার কমিশন নিয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন। অপর প্রান্তের ব্যক্তি তাঁকে ৩ শতাংশ কমিশন দেওয়ার প্রস্তাব দেন। জবাবে মাহফুজ বলেন, “কাজ কনফার্ম করে দিলে ৩ পার্সেন্ট, এটা হইলো? তবে কিছু কাজ আমি ৬ পার্সেন্টে করেছি—এক পার্সেন্ট মিডলম্যানের জন্য, পাঁচ পার্সেন্ট মিনিস্ট্রির জন্য। এগুলো ফিক্সড।”
কথোপকথনে আরও শোনা যায়, কীভাবে কাজের প্রসেস সম্পন্ন হয়। মাহফুজ আলম বলেন, “অ্যাডভাইজার মহোদয় সাইন করবেন, তারপর ৫০ শতাংশ টাকা ছাড় হবে; সিসিজিবি পাস হলে বাকি টাকা দেওয়া হবে। এখন সবকিছু এই ফরম্যাটেই চলছে।” এছাড়া, কথার একপর্যায়ে তিনি হুমকির সুরেও বলেন, “কথা ঠিক না থাকলে আমি ফাইল আটকে রাখব। দুই রকম কথা হলে সমস্যা হবে। আজ ইজিপি করাব, করায়ে নোয়া ঝুলিয়ে রাখব। আপনারা কনফার্মেশন দেবেন, তারপর নোয়া। কিন্তু নির্ধারিত হার থেকে কমানো যাবে না।”
এই অডিও প্রকাশের পর রাজনৈতিক মহলে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। একজন উচ্চপদস্থ উপদেষ্টার এত কাছের একজন প্রেস সেক্রেটারির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সচ্ছ্বতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দেবে।
অন্যদিকে, সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর দাবি করেছেন, এর আগে মাহফুজ আলমের সঙ্গে জড়িত একাধিক অডিও তাঁর হাতে এসেছে। এসব অডিওতে টেন্ডারবাজি ও আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায় বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত দাবি করেছেন এবং বলেছেন, “যদি রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিমুক্ত হতে চায়, তবে এই ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মাহফুজ আলম অবশ্য সবকিছু অস্বীকার করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, “উপদেষ্টা মহোদয়কে হেয় করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আমার নামে যে অডিও ফাঁস করা হয়েছে তা আসলে এআই দিয়ে বানানো মিথ্যা রেকর্ড। আমাকে এবং আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাকে চাপের মধ্যে ফেলতেই এসব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তির এই যুগে যেকোনো অডিও বা ভিডিওকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। অডিওতে শোনা কথোপকথনের ধরণ ও বিষয়বস্তু স্পষ্টতই টেন্ডার কমিশন নিয়ে, যা সাধারণত ভুয়া করে তৈরি করা সহজ নয়। তাই এই অভিযোগকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের মতে, রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করা উচিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে। কেউ কেউ বলছেন, এই ধরনের অডিও ফাঁস দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করছে, আবার অন্যরা মনে করছেন—প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নির্দিষ্ট মানুষকে টার্গেট করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন প্রেস সেক্রেটারির বিরুদ্ধে এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ সামনে আসা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে এটি হবে সরকারের জন্য বড় এক পরীক্ষা, আর যদি প্রমাণিত না হয় তবে তা হবে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আরেকটি দৃষ্টান্ত। যে দিকেই হোক না কেন, এই অডিও ফাঁস অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তিকে ইতোমধ্যেই নানাভাবে নাড়া দিয়েছে।