তালা উপজেলার জালালপুরে ১৯৭১ সালের বর্বর গণহত্যার করুণ ইতিহাস..

শেখ আমিনুর হোসেন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা avatar   
জালালপুরে ১৯৭১ সালের ১২ জুলাই রাজাকার ও মিলিশিয়াদের বর্বর হামলায় নিহত হন ১৭ জন নিরীহ মানুষ..

শেখ আমিনুর হোসেন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া নৃশংস গণহত্যার ঘটনা আমাদের ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর গ্রাম সেই নৃশংসতার এক বাস্তব উদাহরণ। এখানে একদিনের মধ্যেই রাজাকার ও মিলিশিয়ারা মিলিত হয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে। তাদের এই নিপীড়নমূলক আক্রমণের শিকার হয় গ্রামের মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বা নিরীহ গ্রামবাসী।

জালালপুর গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ এবং পশ্চিমে বিল-খাল এলাকাটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল একটি কৌশলগত অবস্থান। ১২ জুলাই দুপুরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা টি করিমের বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এসময় তারা নদীতে একটি গানবোট লক্ষ্য করেন, যা রাজাকার ও মিলিশিয়াদের বোঝাই ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে গানবোটটি দ্রুত পালিয়ে যায়, তবে এতে শত্রুপক্ষের চারজন মিলিশিয়া নিহত হয়।

বিকেলে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প থেকে নতুন করে সংগঠিত হয়ে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা ফিরে আসে এবং শ্রীমন্তকাটি মোড়লবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর তারা জালালপুর শাঁখারিপাড়ায় প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন ৮৫ বছর বয়সী অন্নদা সেন, ২৫ বছর বয়সী অনিমা দাস এবং তার কোলে থাকা এক বছর বয়সী শিশু দীপংকর দাস। আরো যাদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন দুলাল চন্দ্র বর্ধন (৯৫), হরিপদ ঘোষ (৬৫), সাহেব সেন (৩০), উমাপদ দত্ত (৪০), অশোক (৩৫), বাদল প্রামানিক (২৮), সুনীল (৪৫), মোবারক মোড়ল (২৫), আবদুল বারী মোড়ল (৫০), আবদুল মান্নান মোড়ল (৪৫) এবং কৃষ্ণকাটি গ্রামের বদির শেখসহ ১৭ জন। মোবারক মোড়ল ছিলেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।

এই বর্বর হামলায় সুনীল, অন্নদা সেন, অশোক প্রামানিক, বাদল প্রমুখ ৭ জনকে একসাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। আনন্দ দাশের বাড়ির কাজের লোক প্রিতুল কারিগর ও তার বোনও গুলিতে আহত হন। হরিপদ ঘোষকে মাঠে যাওয়ার পথে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়, একই কায়দায় হত্যা করা হয় অধীর ঘোষকেও।

তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন কমান্ডার মোঃ মফিজ উদ্দীন জানান, বিভিন্ন গ্রামে রাজাকাররা অসংখ্য নারী-পুরুষকে হত্যা করে। সরকার ইতিমধ্যে শহীদদের স্মরণে জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে কপোতাক্ষ নদের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে।

অত্র অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে গবেষণাকারী বিশিষ্ট লেখক বদরু মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, তালা ও তার আশেপাশে হত্যাযজ্ঞের ধরণ ও পরিসংখ্যানে প্রমাণিত হয় যে, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদের সিংহভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। এছাড়া যেসব মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বা নিরীহ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের এই করুণ ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতার জন্য কতটা মূল্য দিতে হয়েছে।

এই বর্বর গণহত্যার স্মৃতিচারণা কেবলমাত্র আমাদের দুঃখের কথা নয়, বরং এটি আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনীও জানায়। আমাদের উচিত এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং নিশ্চিত করা যেন এধরনের ঘটনা পুনরায় না ঘটে। এটি আমাদের যুগের প্রয়োজন, যাতে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

Aucun commentaire trouvé