নির্বাচন কমিশনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ শুনানিতে বিএনপি ও এনসিপি নেতাকর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারি হয়েছে। আহত হয়েছেন এনসিপির অন্তত তিনজন নেতা।
রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্ম দিলো সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ শুনানি। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এ শুনানি পরিণত হয়েছে বিএনপি এবং ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) নেতাকর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি ও সংঘর্ষের ঘটনায়।
রোববার (২৪ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের উপস্থিতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসন নিয়ে দাবি-আপত্তির শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার অনুসারীরা এবং এনসিপির নেতাকর্মীরা একে অপরের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। মুহূর্তের মধ্যেই সেই উত্তেজনা রূপ নেয় হাতাহাতি ও মারামারিতে।
এনসিপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের অন্তত তিনজন নেতা- প্রকৌশলী আমিনুল হক চৌধুরী, মুস্তফা সুমন ও আতাউল্লাহ—এই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন। এ বিষয়ে প্রকৌশলী আমিনুল হক চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কেবল সীমানা নিয়ে নিজেদের দাবি জানাতে এসেছিলাম। কিন্তু রুমিন ফারহানার লোকজন আমাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েছে। অপরাধ একটাই— আমরা আমাদের দাবি তুলে ধরেছি।”
অন্যদিকে রুমিন ফারহানা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তিনি দাবি করেন, প্রথম আঘাত এসেছিল এনসিপির দিক থেকে। তার ভাষায়, “প্রথমে তারা আমাদের ধাক্কা দেয়। এটা দেখে আমার অনুসারীরা বসে থাকেনি। তাদের ধাক্কার প্রতিবাদেই আমার লোকজন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।”
এছাড়াও এনসিপির নেতাকর্মীদের পেটানোর প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “তারা আসলেই এনসিপি-জামায়াত ছিল কিনা, নাকি ভাড়াটে গুন্ডা-মাস্তান ছিল সেটা আমরা জানি না।”
সংঘর্ষের সময় নির্বাচন কমিশনের ভেতরে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও পরিস্থিতি শান্ত করতে পারেননি। অবশেষে কমিশনের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে দুই পক্ষকে আলাদা করা হয়।
ঘটনাটি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্য মারামারি শুধু প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ণ করেনি, বরং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপরও আঘাত হেনেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের প্রকাশ্য সহিংসতা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতার দিকেই ইঙ্গিত করছে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন আগে থেকেই রয়েছে, এই সংঘর্ষ সেই বিতর্ককে আরও গভীর করবে বলেই আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের সীমানা নিয়ে স্থানীয়ভাবে আগে থেকেই রাজনৈতিক টানাপোড়েন বিরাজ করছিল। বিএনপি ও এনসিপি উভয় দলেরই দাবি, এই আসনে সীমানা নির্ধারণে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। ফলে দুই পক্ষের উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আজকের ঘটনাটি তারই চরম বহিঃপ্রকাশ।
এই পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরপেক্ষভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারলে কমিশনের ওপর আস্থার সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া রাজধানীর মতো নিরাপদ এলাকায় নির্বাচন কমিশনের ভেতরে এই ধরনের মারামারি হওয়া প্রশাসনিক দুর্বলতারও বহিঃপ্রকাশ— এমন মন্তব্য এসেছে নাগরিক সমাজ থেকেও।
দেশের রাজনীতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা যদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই একে অপরের ওপর আক্রমণ চালায়, তবে সাধারণ মানুষ কিভাবে নির্ভয়ে ভোট দিতে যাবে— সেই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে উঠছে।