সীমাহীন লুটপাটে বিলীনের পথে সিলেটের ‘সাদা পাথর, দিনরাত চলা বেপরোয়া বালু-পাথর লুটে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। প্রশাসনের নীরবতা ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধ্বংস হচ্ছে সিলেটের পর্যটন ঐতিহ্য।
সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক ভোলাগঞ্জের ‘সাদা পাথর’ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একসময় যেখানে ধলাই নদীর স্রোতে ভেসে আসা সাদা পাথরের পাহাড় পর্যটকদের চোখে আনন্দের ঝিলিক ছড়াতো, আজ সেখানে ধুধু বালুচর। সীমাহীন লুটপাটে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, আর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে শুরু হওয়া নির্বিচার লুটপাট গত এক বছরে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে গেছে। প্রতিদিন শত শত নৌকা ধলাই নদীর উৎসমুখে নোঙর করে পাথর ও বালু তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বড়-বড় পাথর থেকে শুরু করে ছোট কণাও রেহাই পাচ্ছে না। এর ফলে সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের আকর্ষণ একেবারে বিলীন হয়ে গেছে, পর্যটকের ভিড় কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই লুটপাটে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের কিছু নেতা, এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কও এ অবৈধ ব্যবসার পেছনের কারিগর বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযানে গেলেও তা কেবল অল্প সময়ের জন্য প্রভাব ফেলে; এরপর আবারও আগের মতো লুটপাট শুরু হয়।
পরিবেশকর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকারও বেশি। সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা বলছেন, প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় সরকারের চরম ব্যর্থতা ও তদারকির অভাব এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এক সময় সিলেটের গর্ব ছিল এই ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, যা এখন লুটপাটের শিকার হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক এস কে দাস সুমন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিশ্বে যেসব প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোতে সরকার নিজেই রক্ষকের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক উল্টোটা ঘটছে—নজরদারির অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনিক উদাসীনতায় প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ আন্দোলনের আরেক নেতা আব্দুল করিম কিমের মতে, গণমাধ্যমে অসংখ্য প্রতিবেদন ও সতর্কতা সত্ত্বেও প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। ধলাই নদীর উৎসমুখে পাথরের পাহাড়ের বদলে এখন কেবল বালুচর, আর পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গভীর গর্ত পর্যটকদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলে দাবি করছে। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি জানিয়েছেন, সাদা পাথরকে কেন্দ্র করে ১৫টি মামলা হয়েছে এবং প্রায় ৭০ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে স্থানীয়দের মতে, লুটপাট ঠেকাতে বড় আকারে সমন্বিত অভিযান জরুরি।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা বলেন, সাদা পাথরকে ইকোলজিক্যালি সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, তাই সরাসরি পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান চালানো যায় না। বিষয়টি মূলত খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর অভিযোগ, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এই লুটপাট দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। তাঁর মতে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও এতে জড়িত, যা উদ্বেগজনক।
বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতা সিদ্দিকী বলেন, প্রকৃত অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে আড়াল করা উচিত নয়। প্রশাসনের ব্যর্থতাই এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ দাবি করেছেন, প্রশাসন প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করছে এবং এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, অভিযান হলেও লুটপাট থামছে না, বরং প্রতিদিন নতুন নতুন কৌশলে তা চলছে।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যদি এখনই রক্ষা করা না হয়, তবে সিলেট হারাবে তার অন্যতম প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, আর সরকার হারাবে বিপুল রাজস্ব আয়। শুধু অভিযান নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে এই প্রাকৃতিক সম্পদকে বাঁচাতে।