শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের নানা বাঁক পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—তিনি কেবল ক্ষমতার জন্যই রাজনীতি করেননি, বরং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনেও ছিলেন প্রবল আগ্রহী। বিশেষ করে, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে এমন কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে, যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে অনেকেই মনে করেন।
তার শাসনামলের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত—পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (১৯৯৭) এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ব্যবস্থাপনা (২০১৭)—এই নোবেল প্রাপ্তির মোহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়: এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি সত্যিই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল, নাকি জাতীয় নিরাপত্তার বিনিময়ে ব্যক্তিগত স্বীকৃতি অর্জনের প্রচেষ্টা?
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত এক নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (JSS) সঙ্গে তার সরকারের সম্পাদিত চুক্তিটি সেই প্রচেষ্টারই অংশ ছিল। চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের সংঘাত নিরসনের প্রচেষ্টা করা হয়, তবে বাস্তবে এটি অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
বিরোধী দলসহ অনেক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক জাতিগোষ্ঠীগুলো বিশেষ সুবিধা পেলেও সাধারণ বাঙালিরা উপেক্ষিত হয়। তাছাড়া, আজ পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং জুম্মদের মধ্যে বিভক্তি, অবৈধ অস্ত্রের আধিপত্য এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটেছে। ফলে, প্রশ্ন ওঠে—এটি কি আসলেই একটি সফল শান্তি চুক্তি ছিল, নাকি শুধুই শেখ হাসিনার নোবেল জয়ের এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা?
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর একটি ছিল ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলা। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন তার সরকার কূটনৈতিকভাবে আরও কঠোর নীতি গ্রহণের পরিবর্তে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে স্বাগত জানায়।
সেসময় কক্সবাজারে এক জনসভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন—
"আমরা ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারি, তাহলে ৭-৮ লাখ রোহিঙ্গাকে খাওয়াতে পারব না কেন?"
তার এই মানবিক অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হলেও, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে কৌশলগত ভুল হিসেবে দেখেন। কারণ, মানবিকতার দোহাই দিয়ে শরণার্থীদের অবাধ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ এখন ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকটের সম্মুখীন। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে, যাদের অনেকেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত। অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান, খুন, অপহরণসহ নানান অপরাধের মাধ্যমে তারা এখন কক্সবাজার অঞ্চলের জন্য এক স্থায়ী হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত মূলত শান্তিতে নোবেল পাওয়ার প্রচেষ্টা ছিল। তবে সেটি ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি দেশকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশে-বিদেশে বহু পদক পেয়েছেন। বিশেষ করে, তার সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত লবিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তার বহু আকাঙ্ক্ষিত নোবেল পুরস্কার আর পাওয়া হয়নি।
এর পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে—
-
আন্তর্জাতিক কূটনীতির ব্যর্থতা:
শেখ হাসিনা বারবার চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক মহলে এমন কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেননি, যা সত্যিই নোবেল পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। -
কৃত্রিম প্রচারণার দুর্বলতা:
তার নোবেল প্রাপ্তির লবিং কার্যক্রমকে পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি, কারণ সেটির পেছনে স্বতঃস্ফূর্ত কোনো ঐতিহাসিক অবদান ছিল না। -
শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা:
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হয়নি, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা রয়ে গেছে এবং দেশে স্বৈরাচারী শাসনের অভিযোগ উঠেছে। ফলে, তিনি শান্তির দূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
একজন রাজনীতিবিদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা দোষের কিছু নয়। তবে যখন সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাতীয় স্বার্থকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়, তখন তা কেবল নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত হয়।
শেখ হাসিনার নোবেল পাওয়ার মোহ তাকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি আজও সমস্যাসঙ্কুল, রোহিঙ্গা সংকট দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, এবং সর্বোপরি, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে তার সরকার দেশীয় রাজনীতি ও নীতি নির্ধারণে বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
অতএব, প্রশ্ন থেকেই যায়—শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ কি চিরস্থায়ী সমস্যার বেড়াজালে আটকে গেল? এই উত্তর সময়ই বলে দেবে।



















