পাবনার চাটমোহরে সয়াবিন তেল, ডিটারজেন্ট ও জেলি দিয়ে ভেজাল দুধ তৈরি করছিলেন কৃষকদল নেতা আবদুল মমিন। প্রাণ ও ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এসব দুধ সরবরাহ হতো। অভিযান চালিয়ে ৭০০ লিটার ভেজাল দুধ ও সরঞ্জাম জব্দ করেছে প্রশাসন।
পাবনার চাটমোহরে ভয়াবহ ভেজাল দুধ কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে। স্থানীয় কৃষকদল নেতা আবদুল মমিন দীর্ঘদিন ধরে সয়াবিন তেল, ডিটারজেন্ট ও জেলি মিশিয়ে কৃত্রিম দুধ তৈরি করছিলেন। এই ভেজাল দুধ সরবরাহ করা হতো দেশের নামী ব্র্যান্ড প্রাণ, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর এলাকায় চরম ক্ষোভ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
গত সোমবার রাতে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসা নাসের চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রশাসন বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় প্রায় ৭০০ লিটার ভেজাল দুধ এবং ভেজাল তৈরির সরঞ্জাম, যেমন ডিটারজেন্ট গুঁড়া, সয়াবিন তেল, রাসায়নিক পদার্থ, ব্লেন্ডার মেশিন, গ্যাস সিলিন্ডার ও চুলা জব্দ করা হয়। তবে অভিযুক্ত আবদুল মমিন আগেই কারখানা থেকে পালিয়ে যায়, ফলে তাকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
অভিযানে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ভেজাল দুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। দুধে ডিটারজেন্ট ও রাসায়নিক মিশিয়ে কৃত্রিম ফ্যাট বৃদ্ধি করা হলেও, এগুলো খেলে ক্যানসার, লিভার জটিলতা, কিডনি রোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর এস এম আসলাম হোসেন বলেন, “এভাবে তৈরি দুধ সরাসরি মানুষের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। এটা মারাত্মক অপরাধ এবং ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকট ডেকে আনতে পারে।”
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আবদুল মমিনের কারখানা থেকে প্রতিদিন গুনাইগাছা ইউনিয়নের চরপাড়া এলাকায় অবস্থিত প্রাণ ও ব্র্যাক কোম্পানির চিলিং সেন্টারে দুধ সরবরাহ করা হতো। শ্রমিক রায়হান আলী জানান, “সবচেয়ে বেশি দুধ যেত ব্র্যাক সেন্টারে। মানুষ জানতেই পারেনি, এই দুধ আসলে ভেজাল।”
এ বিষয়ে প্রাণ ডেইরি হাব চাটমোহরের এরিয়া ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, “আগে আমরা তার কাছ থেকে দুধ নিতাম, কিন্তু এখন আর গ্রহণ করছি না।” ব্র্যাক চরপাড়া সেন্টারের ইনচার্জ নাজনীন আক্তার বলেন, “আমরা দুধ নেওয়ার আগে পরীক্ষা করি। টেস্ট রিপোর্ট ছাড়া কোনো দুধ গ্রহণ করা হয় না।”
তবে এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনেও সমালোচনা শুরু হয়েছে। কৃষকদলের স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি আগে জানতেন না। উপজেলা কৃষকদলের সভাপতি লিটন বিশ্বাস বলেন, “এমন ঘটনায় যদি সত্যতা মেলে, তবে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশাসন জানিয়েছে, ভেজাল দুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। ইউএনও মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, “আসামি পলাতক থাকায় তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আইনগত প্রক্রিয়া চলছে এবং দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক আলোচনা চলছে। সাধারণ মানুষ বলছেন, “যে দুধ আমরা শিশু থেকে বয়স্ক সবাই খাই, তা যদি ডিটারজেন্ট দিয়ে তৈরি হয়, তবে সমাজ কোথায় দাঁড়াবে?” জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া না হলে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে থাকবে এবং বাজারে খাদ্যের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অভিযুক্ত আবদুল মমিনের বিষয়ে সাংবাদিকরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি প্রথমে কল রিসিভ করে পরিচয় জানতে চান। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরপরই তিনি ফোন কেটে দেন এবং আর যোগাযোগে আসেননি। তার বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পাবনা চাটমোহরের এ ঘটনা শুধু একটি ভেজাল কারখানার কাহিনী নয়, বরং গোটা খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার একটি বড় প্রমাণ। মানুষ এখন প্রশ্ন তুলছে, আর কতদিন তারা বিষাক্ত দুধ ও খাবারের ঝুঁকিতে থাকবে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত পদক্ষেপ ছাড়া এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হবে না।