close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

"UNDP’র অর্থ লুটে নারীদের টার্গেট: ফেনীতে আত্মসাৎ চক্রের চাঞ্চল্যকর রহস্য ফাঁস"..

Monsur Alam avatar   
Monsur Alam
"UNDP’র অর্থ লুটে নারীদের টার্গেট: ফেনীতে আত্মসাৎ চক্রের চাঞ্চল্যকর রহস্য ফাঁস"..

২০২৪ সালে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) থেকে বরাদ্দকৃত ৩০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান আত্মসাতের একটি কৌশলী চক্র ফেনীতে সক্রিয় রয়েছে। সেই চক্রের অন্যতম সদস্য রিকশা চালক মোঃ সবুজ,যিনি নারীলোভী প্রকৃতির লোক এবং দীর্ঘদিন নারীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ ও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

‎অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রিকশা চালক সবুজ সহ আরো তিন জনের নাম তবে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত আছে আরো অনেক সদস্য। অনেক নারী যাত্রী আছেন যারা সবুজে রিক্সার যাত্রী ছিলেন। যাদের নাম ‘UNDP’র বন্যা তহবিল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন সবুজ। কৌশলে তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

‎চক্রের কার্যপদ্ধতি: টার্গেট নারী, কৌশলে তথ্য সংগ্রহ

‎তদন্তে উঠে এসেছে, অভিযুক্ত মোঃ সবুজ মূলত তার রিকশার নারী যাত্রীদেরকেই টার্গেট করতেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)-এর অর্থ সহায়তার নামে তিনি একটি চক্রের হয়ে কাজ করতেন। তার কৌশল ছিল, UNDP’র তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের সঙ্গে চুক্তি করা।

‎এই চুক্তির আওতায় নারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হতো জাতীয় পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) ও মোবাইল নাম্বার। সবুজ নিজে একাধিকবার বলেছেন, UNDP’র ঘোষিত ৩০,০০০ টাকার মধ্যে উপকারভোগী নারীদের হাতে দেওয়া হতো মাত্র ১০,০০০ টাকা। বাকি ২০,০০০ টাকা ভাগাভাগি করে নিতো চক্রের সদস্যরা। যার মধ্যে সবুজ প্রতি নারীর ক্ষেত্রে পেতেন ৫,০০০ টাকা।

‎এই পুরো প্রক্রিয়া ছিল এক ধরনের প্রতারণা ও শোষণমূলক ব্যবস্থা, যেখানে দরিদ্র নারীদের অর্থ ও সম্মান দুই-ই হুমকির মুখে পড়েছিল। সবুজের এই অপকৌশল বহু নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‎বন্যার্তদের তালিকায় প্রতারণা: কৌশলে বিকাশ নাম্বার ঢুকিয়ে অর্থ আত্মসাৎ

‎গোপন অনুসন্ধানে প্রতিবেদক সবুজ থেকে কৌশলে জানতে পারেন, ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নে ২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রস্তুত করা UNDP-এর তালিকায় নিজের চক্রের সদস্যদের তথ্য ঢুকিয়ে দেন। তিনি স্বীকার করেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আসল সদস্যদের নাম বাদ দিয়ে, তালিকায় যুক্ত করা হয় চক্রের পছন্দের ব্যক্তিদের বিকাশ নাম্বার—যেখানে টাকা গিয়ে জমা হতো।

‎সবুজ জানান, তারা মূলত নারীদেরকেই টার্গেট করেন। চক্রের পুরুষ সদস্যরা যেসব নারীকে মানসিক বা আর্থিকভাবে দুর্বল মনে করেন, তাদেরকেই ভুয়া নাম্বার ও পরিচয় দিয়ে তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেই টাকার একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে নারীদের খুশি করা হয়, আর বাকি টাকা ভাগাভাগি করে নেয় চক্রের সদস্যরা।

‎এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি পূর্বপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ প্রতারণার উদাহরণ—যেখানে দরিদ্র ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের প্রকৃত অধিকার হরণ করা হয়েছে, এবং একটি অপরাধী চক্র মুনাফা করেছে বিদেশি সহায়তা লুট করে।

‎তদন্ত ও সাক্ষাৎকারের বিবরণ

‎অভিযুক্ত মোঃ সবুজের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রতিনিধির পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সবুজ প্রথমে লেমুয়া বাজারে সাক্ষাৎ করার কথা বলেন। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত হলেও, বারবার ফোন করা সত্ত্বেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও তার দেখা মেলেনি।

‎পরে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে, যেখানে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও স্পষ্ট হুমকিস্বরূপ কথা শোনা যায়। স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান করে জানা যায়, ওই নম্বরটি মাস্টারপাড়া এলাকার মোঃ বেলাল নামের এক রিকশা চালকের বলে চিহ্নিত হয়েছে।

‎তবে সরাসরি সাক্ষাতের আগে গোপনে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একজন সাধারণ যাত্রী হিসেবে সবুজের রিকশায় ওঠেন প্রতিনিধি। এ সময় কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য নেওয়া সম্ভব হয়েছে, যা তদন্তের কাজে সহায়ক হবে।

‎সবুজের ব্যক্তিগত জীবন ও সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড

‎অভিযুক্ত মোঃ সবুজ নিজেকে নোয়াখালীর বাসিন্দা দাবি করলেও তার ভাষার ধরণ, আচরণ এবং স্থানীয়দের মতামত থেকে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি নোয়াখালীর কেউ নন বরং অন্য কোনো জেলার বাসিন্দা হতে পারেন। প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর ধরে তিনি লেমুয়া এলাকায় বসবাস করছেন, কিন্তু এতো দীর্ঘ সময়েও তাকে কখনো ঈদ বা বিশেষ কোনো দিনে নিজ বাড়িতে যেতে দেখা যায়নি। এতে সন্দেহ জন্মেছে যে, তিনি হয়তো কোনো মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।

‎স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, সবুজ একজন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি এবং অতীতে বিভিন্ন নারীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তা বিক্রি ও ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

‎সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) থেকে অর্থ বিতরণের পর সবুজ দুইজন নারী উপকারভোগীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আরও অর্থ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ওই দুই নারীর সঙ্গে অসামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের অপচেষ্টা চালান। এই তথ্য পাওয়ার পর আমাদের অনুসন্ধান শুরু হয়।

‎তদন্তের অংশ হিসেবে সবুজের মোবাইল নাম্বারের কললিস্ট বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা গেছে, সবুজ শুধু দিনে নয়, গভীর রাতেও ঐ দুই নারীর সঙ্গে নিয়মিতভাবে দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলেন। প্রায় প্রতিদিন এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কথা বরেন এবং রাত ১২টার পর এক নারীকে ইমোতে কল দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। যদিও ওই নারীদের একজন ফোন রিসিভ করেননি, তথাপি প্রশ্ন থেকে যায়—সবুজের ফোন কল নারীরা গ্রহণ করেন কেন?

‎স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, সবুজ এমনভাবে কৌশলে কথা বলেন যে, নারীরা ফোন রিসিভ না করেও পারেন না। বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, এক নারীর মোবাইল নম্বরে সবুজই নিয়মিত কল করতেন।

‎তবে ভুক্তভোগী নারীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের কথা বিবেচনা করে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। কমেন্ট বক্সে সবুজের কল লিস্টের কয়েকটি স্ক্রিনশট সংযুক্ত করা হলো, যা এ অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

‎নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল: প্রতারণার ফাঁদে মানবিকতার মুখোশ

‎তদন্তে জানা যায়, রিকশাচালক মোঃ সবুজ কৌশলে কিছু নারী যাত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তার লক্ষ্য ছিল প্রবাসীর স্ত্রী ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীরা, যারা একাকিত্বে ভুগছেন বা সহানুভূতির আশায় থাকেন। সবুজ নিজেই বিভিন্ন মাধ্যমে নারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন—কে কোন পরিস্থিতিতে আছেন, কেমন মানসিক দুর্বলতা রয়েছে, সেটিও তিনি আগেই যাচাই করে নিতেন।

‎তার অন্যতম কৌশল ছিল, রিকশায় কোনো সুন্দরী নারী যাত্রী উঠলে, যদি তার সঙ্গে ছোট কোন বাচ্চা থাকে, তাহলে সেই বাচ্চাকে চিপস বা জুস কিনে দেওয়া। স্থানীয় একটি প্রচলিত কথা আছে—"হোলার হাতে খাবার দিলে হোলার মা'র মন পাওয়া যায়"—সে এইভাবে মায়ের মন জয়ের চেষ্টা করতো।

‎এছাড়াও, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়া নেওয়া, কিংবা বিনামূল্যে বাজার করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া ছিল তার আরেকটি সাধারণ কৌশল। “আপনার কোনো বাজার সদাই লাগলে আমাকে বলবেন, আমি মুহূর্তেই এনে দেব”—এই ধরণের কথার মাধ্যমে নারীদের মন জয় করতেন তিনি।

‎শুধু নারীদের নয়, সবুজ স্থানীয় কিছু পুরুষদের প্রতিও ‘উপকারি ও সস্তা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে সম্পর্ক তৈরি করে নিতেন। যেমন—কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে ভাড়া না নেওয়া, চায়ের দোকানে নিয়ে চা খাওয়ানো ইত্যাদি। যাতে করে পরবর্তীতে কেউ যদি সবুজের বিরুদ্ধে কিছু বলে, তখন এসব পুরুষরা তার পক্ষ নিয়ে কথা বলেন।

‎এই মানবিকতার মুখোশে লুকিয়ে থাকা কৌশলী আচরণ আসলে একটি পরিকল্পিত প্রতারণার ফাঁদ—যার শিকার হচ্ছেন সহজ-সরল নারীরা এবং সমাজের অসচেতন মানুষ।

‎সামাজিক প্রভাব ও হুমকি: ভুক্তভোগীদের আতঙ্কে দিনযাপন

‎মোঃ ফরিদ নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা প্রতিবেদককে জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ মুখ খুলতে ভয় পান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী জানান, এই চক্রের সদস্যরা নির্ধারিত টাকার চুক্তি অনুযায়ী টাকা না পেলে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে থাকে।

‎এক ভুক্তভোগী জানান, “তাদের কথামতো টাকা না দিলে আমাদের তুলে নিয়ে যাবে এবং রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে টাকা আদায় করবে।” শুধু হুমকিতেই সীমাবদ্ধ নয়, এসব ঘটনার সঙ্গে রয়েছে কুরুচিপূর্ণ গালিগালাজ ও শারীরিক ভয়ভীতির আশঙ্কাও।

‎প্রতিবেদকের কাছে ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য এবং হুমকির অডিও প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। জানা যায়, চক্রের অন্তত দুই সদস্যের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং অনেকেই মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না।

‎এ অবস্থায় এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন, যেন চক্রটিকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা যায়।

‎🎥 

No comments found