পর্তুগালে অতি দক্ষিণপন্থী চেগা পার্টির উত্থাপিত বিল অনুযায়ী জনসমক্ষে ‘ধর্মীয় উদ্দেশ্যে’ নিকাব পরা নিষিদ্ধ হলো; লঙ্ঘনে উচ্চ অঙ্কের জরিমানা ও কারাদণ্ডের প্রস্তাব।
ইউরোপের দেশগুলোর তালিকায় নাম লেখাতে চলেছে পর্তুগাল। অতি দক্ষিণপন্থী দলের উত্থাপিত একটি বিলের মাধ্যমে সেখানে অধিকাংশ উন্মুক্ত স্থান বা জনসমক্ষে ‘লিঙ্গভিত্তিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে’ নিকাব পরা নিষিদ্ধ করতে পার্লামেন্টে বিল পাস হয়েছে। এই বিতর্কিত বিলটি মূলত মুসলিম নারীদের বোরকা ও নিকাবের ব্যবহারকে লক্ষ্য করে পার্লামেন্টে তোলা হয়েছিল।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) পর্তুগালের পার্লামেন্টে বিলটি পাস হয়। বিলটিতে জনসমক্ষে নিকাব পরলে ২০০ থেকে ৪ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে, কোনো ব্যক্তিকে নিকাব পরতে বাধ্য করলে সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে কিছু বিশেষ স্থান। এই স্থানগুলো হলো—উড়োজাহাজ, কূটনৈতিক প্রাঙ্গণ ও উপাসনালয়গুলো। অন্যান্য সকল জনসমাগমপূর্ণ স্থানে মুসলিম নারীদের মুখ আবৃত করে চলাফেরা নিষিদ্ধ করা হলো এই বিল পাসের মাধ্যমে।
বিলটি উত্থাপন করেছিল পর্তুগালের অতি দক্ষিণপন্থী চেগা পার্টি। বিলটি পাসের সময় চেগা পার্টির নেতা আন্দ্রে ভেনচুরা বলেন, "আজ আমরা পার্লামেন্টের নারী সদস্যদের, আপনাদের মেয়েদের, আমাদের মেয়েদের এই দেশে একদিন বোরকা পরার হাত থেকে রক্ষা করছি।" তিনি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’ (পূর্বে টুইটার)-এ এই দিনটিকে গণতন্ত্র, মূল্যবোধ, পরিচয় ও নারীর অধিকার রক্ষার জন্য ঐতিহাসিক একটি দিন হিসেবে বর্ণনা করেন।
অন্যদিকে, পার্লামেন্টে এই বিল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির আইনপ্রণেতা আন্দ্রেয়া নেটো বিল পাসের আগে বলেন, এটি নারী ও পুরুষের সমতা নিয়ে বিতর্ক। তিনি যুক্তি দেন যে, কোনো নারীকে তার মুখ ঢেকে রাখতে বাধ্য করা উচিত নয়।
পার্লামেন্টের অধিবেশনে বামপন্থী দলগুলোর কয়েকজন নারী আইনপ্রণেতা বিলটির কঠোর বিরোধিতা করেন। তবে মধ্যদক্ষিণপন্থী জোটের সমর্থনে বিলটি শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, পার্লামেন্টের মোট ১০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দুটি দল—পিপল-অ্যানিমেলস-নেচার পার্টি ও টুগেদার ফর দ্য পিপল পার্টি—ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে, কারণ তারা মনে করে এই প্রস্তাব বৈষম্য উসকে দিয়েছে।
বিলটি পার্লামেন্টে পাস হলেও এটি আইনে পরিণত হওয়ার আগে আরও কয়েকটি ধাপ পেরোতে হবে। পর্তুগালের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বিলটি এখন সাংবিধানিক বিষয়–সম্পর্কিত আইন পর্যালোচনার দায়িত্বে থাকা সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হবে।
এই আলোচনার পর বিলটি চূড়ান্ত আইনে পরিণত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট মার্সেলো রেবেলো ডি সুজা এই বিলটিতে ভেটো দিতে পারেন কিংবা আরও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সাংবিধানিক আদালতে পাঠাতে পারেন বলে জানা গেছে।
বিলটি আইনে পরিণত হলে পর্তুগালও ইউরোপের সেসব দেশের তালিকায় নাম লেখাবে, যারা জনসমক্ষে নিকাব পরার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বর্তমানে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসে উন্মুক্ত স্থানে নিকাব পরা আংশিক বা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। পর্তুগালের এই সিদ্ধান্ত দেশটিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন অনেকে।
পর্তুগালে জনসমক্ষে নিকাব নিষিদ্ধের বিল পাস একদিকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার বিতর্ক উসকে দিলো, অন্যদিকে তা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দের অধিকারের উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রশ্নও তুললো।