বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর অন্যতম শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কারের আবহে নির্বাচন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি নিয়ে দলের স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন, বিশেষ করে নির্বাচনী পদ্ধতি সংক্রান্ত, তা অবশ্যই আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এছাড়াও, তিনি বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার ওপর আঘাত হানার অপচেষ্টা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের লক্ষ্যে তিনি একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে বর্তমান অন্তর্পতি সরকার এই লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। তার মতে, নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করলেও মাঝে মাঝে কিছু বিষয় সামনে আসছে, যা উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের জন্য যে সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, সেটির কাজ প্রায় শেষের দিকে বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি উল্লেখ করেন, কমিশন ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতামত বিনিময় শেষ করেছে। আগামী ১৭ তারিখে দলগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোতে স্বাক্ষর সম্পন্ন হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সামনে এসেছে, তা হলো প্রপোশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। এই পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সমাজে আলোচনা এবং আন্দোলন শুরু হলেও মির্জা ফখরুল এর বিরোধিতা করেন।
তার মতে, এই পিআর ইস্যুটি এখন তড়িঘড়ি করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আগামী পার্লামেন্টের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তার যুক্তি হলো, যদি নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং জনগণ মনে করেন যে তারা পিআর পদ্ধতিতে যাবেন, তবেই এটি কার্যকর করা উচিত।
বিএনপি নেতা পিআর পদ্ধতি অবিলম্বে গ্রহণের বিরোধিতায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত ৫০ বছর ধরে, এমনকি ব্রিটিশ আমল থেকেই, বাংলাদেশ 'এক ব্যক্তি এক ভোট' পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। এই পরিচিত ও দীর্ঘদিনের চর্চিত পদ্ধতি থেকে হঠাৎ করে পিআর-এ গেলে সাধারণ জনগণ এই পদ্ধতি বুঝতে পারবে না।
তিনি পিআর পদ্ধতির একটি মৌলিক দুর্বলতা চিহ্নিত করেন। তার বিশ্লেষণে, এই পদ্ধতিতে একজন নাগরিক তার পছন্দের কোনো ব্যক্তিগত প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা হারান। এর বদলে ভোটারকে মূলত একটি দলকে ভোট দিতে হয়, যা ব্যক্তির স্বাধীন পছন্দকে গৌণ করে তোলে।
রাজনৈতিক সংস্কার এবং নির্বাচনের আলোচনার পাশাপাশি মির্জা ফখরুল দেশের অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা নিয়েও কথা বলেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চাওয়া হয়েছিল, সেখানে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তিনি এবং তার দল এই অপচেষ্টার কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন যে আগামী নির্বাচনে জনগণ তাদের রায় দেবে যে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থেই অসাম্প্রদায়িক এবং তারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
তার মতে, বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র এবং জাতিসত্তার ভিত্তি হলো ১৯৭১ সালের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। এই মূল নীতিকে নষ্ট হতে দেওয়া হবে না এবং ভিন্নভাবে চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই। সমগ্রভাবে বাংলাদেশের মানুষ একটি জাতি—এই ঐক্যবদ্ধতার ওপরই তিনি জোর দেন।
তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িত, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হলো জনগণের ভোটে গঠিত পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ।