অনলাইন ক্যাসিনো: একটি ধ্বংসযাত্রার গল্প

MD Ariful Islam avatar   
MD Ariful Islam
অনলাইন ক্যাসিনোতে অর্থ হারানোর পরিণাম হিসেবে মানসিক বিপর্যয় ও সামাজিক অনুরাগ প্রকাশ করে সমাজের যুবক ও অন্যান্য বয়স্ক ব্যক্তির জীবন।....

আমি কখনো অনলাইন ক্যাসিনো খেলতে যাইনি, কিন্তু যারা গিয়েছে তাদের অনেকের খুব কাছাকাছি থেকেছি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, চুপচাপ দেখে গেছি কীভাবে এই চকচকে আলো, চমকপ্রদ জেতার লোভ, আর অস্থায়ী আনন্দ একটা তরতাজা জীবনকে নিঃশেষ করে দিতে পারে।  

 

প্রথমে মনে হয়, “একটু খেলেই বা কী হবে?” কিন্তু আসল ফাঁদটা এখানেই। প্রথমে শুরুতে খেলে অল্প টাকা কম বেশি সবাই পায়, অতঃপর বাড়তে থাকে আর পাওয়ার প্রলোভন। আসতে আসতে এটার মাঝে ডুকতে থাকে। একবার যখন ঢুকে পড়ে, তখন মনে হয় পরের বারই বুঝি ভাগ্য খুলে যাবে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত একটার পর একটা বাজি ধরা পেছনে পড়ে থাকে পরিবার, পড়াশোনা, ভালোবাসা, স্বপ্ন।  

 

আমি দীর্ঘদিন লক্ষ্য করলাম, ফেইসবুক স্ক্রল করলে দেখা যায় অনলাইন ক্যাসিনোর অ্যাড, আর অ্যাড এমন ভাবে করে যা মানুষ একবার হলেও খেলতে বাধ্য। আর কেনই বা বাধ্য হবে না? সকলের স্বপ্ন থাকে একদিন অনেক টাকার মালিক হবে, সকল স্বপ্ন পূরণ করবে। আর অনলাইল ক্যাসিনো মানুষের সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমাজের কিছু শ্রেণীর মানুষের অ্যাড এর মাধ্যমে সেই স্বপ্ন দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। আর ধ্বংসের মুখে পড়ছে সেই সব পরিবার, সেই মানুষটি।

 

আমি এমন অনেক তরুণকে দেখেছি, যারা অনলাইন ক্যাসিনোতে ঢুকে নিজের শেষ টাকাটুকু হারিয়ে ভোরবেলা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। কারো চোখে হতাশা, কারো চোখে গোপন কান্না। কেউ কেউ ধার করে, বন্ধুবান্ধবদের বিশ্বাস ভাঙে, এমনকি পরিবারকেও ঠকায় শুধু সেই মিথ্যা “বড় জয়ের” আশায়।

 

ক্যাসিনো শুধু টাকা খেয়ে না, এটা একজন তরুণের আত্মবিশ্বাস, সম্ভাবনা, আর মূল্যবোধও গিলে ফেলে। আমি এক বন্ধুকে দেখেছি, যে এক সময় সমাজসেবায় যুক্ত ছিল, অনলাইন ক্যাসিনোর প্রতি আসক্ত হয়ে সে আজ পরিচিত জনদের কাছেও লুকিয়ে চলে।  

 

আমার কাছের বন্ধু অনলাইন ক্যাসিনো খেলে, আমি একদিন সন্ধায় তার পাশে কাঁধে হাত দিয়ে বসি, জিজ্ঞেস করবো কি করিস? তখনই আমার নজর যায় তার মোবাইলের দিকে, দেখি সে ক্যাসিনো খেলছে। দেখলাম সে ৫০০ (পাঁচশত) টাকা একাউন্টে ডুকালো। দেখলাম সে কিছু টাকা বাজিতে লাগিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে, যেন সে ভালো কিছু পায়। ঠিক তাই সে মোটামুটি অনেক গুলো টাকা পেয়েছে। তখন দেখি তার মুখে কি সুন্দর মৃদু হাসি। গল্পের মাঝে বললাম এই টাকা দিয়ে কি করবি? উত্তরে বলে ঈদের কেনাকাটা করবো। আর যদি আরো পায় তাহলে একটা দামী মোবাইল কিনবো। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, তার লোভ ডুকে গেছে। বর্তমানে সে ক্যাসিনোতে টাকা হারিয়ে মন মরা।

 

অন্য দিকে আমার আরেক বন্ধু ডেইলি কাজ করতো, মানুষের মুখে ক্যাসিনোতে টাকা পাওয়ার কথা শুনে সে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি, সেও শুরু করে অনলাইন ক্যাসিনো খেলা। পরে শুনতে পায় সে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা হারিয়েছে এই অনলাইন ক্যাসিনোতে।

 

ঠিক এমন হাজারো নিঃশব্দ ধ্বংসযাত্রার গল্প আছে, কারোটা প্রকাশ পেয়েছে, আবার কারো গোপন রয়ে গেছে। তবে এখানে সব চেয়ে বেশি যে বিষয়টি লক্ষ্য করলাম সেটি হলো, বেশিরভাগ যুব সমাজ এই অনলাইন ক্যাসিনোতে আসক্ত। তার মধ্যে বেশির ভাগ ডেইলি কাজ করে।

 

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এই আসক্তি ধীরে ধীরে একজন মানুষের চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত নষ্ট করে দেয়। ক্যাসিনো তার শিকারকে এমন এক মানসিক বন্দিত্বে ফেলে দেয়, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন।

 

আমার এই লেখা কোনো গল্প নয় এটা বাস্তব। এ এমন এক বাস্তবতা, যা আমি অনুভব করেছি, চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। বর্তমান সমাজে যুবক, মধ্য বয়সী সহ মোটামুটি সব বয়সী অধিকাংশই এই অনলাইন ক্যাসিনোতে আসক্ত।

 

সমাজ যদি এখনই সচেতন না হয়, যদি আমরা পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর রাষ্ট্র একসাথে মিলে এর বিরুদ্ধে না দাঁড়াই তাহলে একদিন হয়তো একটি প্রজন্মকে হারাতে হবে এই নিঃশব্দ ‘জুয়া’র কাছে।

No comments found